Sunday, March 26, 2017

কবর যিয়ারত সংক্রান্ত কতিপয় জাল ও দুর্বল হাদীস

কবর যিয়ারত সংক্রান্ত কতিপয় জাল ও দুর্বল হাদীস

কবর যিয়ারত সংক্রান্ত কতিপয় জাল ও দুর্বল হাদীস


  •                                             বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম

                                         পরম করুনময় আল্লাহর নাম সরন করি
                                                   সগ্রহকারি মোঃ রোকন সরকার


মানুষকে যেখানে দাফন করা হয় তার নাম কবর। দুনিয়ায় এটাই তার সর্বশেষ ঠিকানা। যখন দাফন করা হয়, জীবিতদের সাথে তার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় এবং সে চলে যায় অদৃশ্য জগতে। মানুষ অনেকটা অসহায় এবং আল্লাহর তাকদীরের কাছে অপারগ হয়ে প্রস্থান করে কবরের জগতে। মৃত্যুর বিভীষিকা, কবরের চাপ অতঃপর ফিরিশতাদের প্রশ্ন, হাশরের ময়দানে উত্থান, হিসাব-নিকাশ ও কিসাস অর্থাৎ যুলুমের বদলা নেকীর বিনিময় কিংবা পাপের বোঝা গ্রহণ করে এবং ডান হাত কিংবা বাঁ হাতে আমলনামা প্রাপ্তির গভীর উৎকণ্ঠার মতো নিদারুণ অবস্থার সম্মুখীন হয় পর পর। মৃত এ ব্যক্তিকে কাণ্ডজ্ঞানহীন মূর্খ কবর পূজারী কতিপয় জীবিত মানুষের অন্তরে মহা শক্তিধর হিসেবে পেশ করে শয়তান, ফলে তারা দো‘আ, সুপারিশ ও কল্যাণ লাভ করার আশায় ছুটে যায় তাদের কবরে, পেশ করে টাকা-পয়সা, বিভিন্ন নজর-নেওয়াজ ও ত্যাগ-কুরবানী।
আমাদের পূর্ববর্তী উম্মতকে শয়তান এভাবেই গোমরাহ ও পথভ্রষ্ট করেছে, সত্যকে আড়াল করে তাদের সামনে তুলে ধরেছে বাতিলকে। আল্লাহ তা‘আলা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে প্রেরণ করে সে মূর্খতা ও অন্ধকার উম্মত থেকে দূর করেন। তিনি কবর যিয়ারত সম্পূর্ণ নিষেধ করে দেন, যেন জাহেলী কুসংস্কার, শির্কী আকীদা, বিচ্যুতি ও শয়তানী সংশয় থেকে তাদের অন্তর সফেদ ও পরিচ্ছন্ন হয়। অতঃপর যখন তাদের আকীদা পরিশুদ্ধ ও পরিপক্ব হলো, তাওহীদের আলোয় তাদের হৃদয়-কুন্দর ভরে গেল, তিনি ঘোষণা দিলেন:
«كنت نهيتكم عن زيارة القبور فزوروها» مسلم و زاد الترمذي: «فإنها تذكركم الآخرة»، وعند أبي داود: «فإن في زيارتها تذكرة». ولفظ النسائي: «نهيتكم عن زيارة القبور، فمن أراد أن يزور فليزر، ولا تقولوا هُجراً»
“আমি তোমাদেরকে কবর যিয়ারত থেকে নিষেধ করেছিলাম, তোমরা তা যিয়ারত কর”।[1] ইমাম তিরমিযী অতিরিক্ত বর্ণনা করেন: “কারণ তা আখেরাত স্মরণ করিয়ে দেয়”।[2] ইমাম আবু দাউদ তার পরিবর্তে বলেন: “কারণ তার যিয়ারত করায় উপদেশ রয়েছে”।[3] ইমাম নাসাঈ-এর বর্ণনা করা শব্দ হচ্ছে: “কবর যিয়ারত থেকে তোমাদেরকে নিষেধ করেছিলাম, অতএব, যে যিয়ারত করার ইচ্ছা করে সে যিয়ারত করুক, তবে তোমরা বেহুদা কথা বল না”।[4]
তিনি উম্মতকে সতর্ক করে বলেন, যেন তারা দূর আগামীতে শয়তানের বিস্মৃতি ও প্রতারণায় সঠিক পথহারা না হয়:
«لعن الله اليهود والنّصارى اتخذوا قبور أنبيائهم مساجد» و في مسند الإمام أحمد: «اللهم لا تجعل قبري وثنا ، لعن الله قوما اتخذوا قبور أنبيائهم مساجد»
“আল্লাহ ইয়াহূদী ও খ্রিস্টানদের লা‘নত করুন, তারা তাদের নবীদের কবরকে মসজিদ বানিয়েছে”।[5] আবু হুরায়রা থেকে ইমাম আহমদ বর্ণনা করেন: “হে আল্লাহ আমার কবরকে প্রতিমা[6] বানিও না, আল্লাহ সে জাতিকে লা‘নত করুন, যারা তাদের নবীদের কবরকে মসজিদ বানায়”।[7]
কবর যিয়ারত করার বৈধতা থেকে কেউ যেন তার উপর নির্মাণ করা, তাকে ঘিরে বসা ও তা ইবাদাত খানায় পরিণত করার ভ্রান্তিতে লিপ্ত না হয় তাই আরো সতর্কতা অবলম্বন করেন। আবু সাঈদ খুদরী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিষেধ করেছেন,
«أن يبنى على القبور ,أو يقعد عليه, أويصلى عليها»
“কবরের উপর নির্মাণ করা, তার উপর বসা অথবা তার উপর সালাত পড়া থেকে”।[8]
আলী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু আবুল হাইয়াজ আল-আসাদীকে বলেন, আমি কি তোমাকে সে কাজের জন্য প্রেরণ করব, যার জন্য আমার অন্তরঙ্গ বন্ধু আমাকে প্রেরণ করেছেন?
«اذهب فلا تدع تمثالا إلا طمسته ,ولا قبرا مشرفا إلا سويته»
“যাও, কোনো মূর্তি রাখবে না অবশ্যই তা ধ্বংস কর, আর না রাখবে কোনো উঁচু কবর, অবশ্যই তা বরাবর কর”।[9]
জাবের রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিষেধ করেছেন:
«أن يجص القبر، وأن يقعد عليه، وأن يبنى عليه». رواه أحمد، ومسلم، والنسائي، وأبو داود، والترمذي وصححه. ولفظه: «نهى أن تجصص القبور، وأن يكتب عليها، وأن يبنى عليها، وأن توطأ». وفي لفظ النسائي: «أن يبنى على القبر، أو يزاد عليه، أو يجص، أو يكتب عليه».
“যেন কবর পাকা (বা টাইলস) করা না হয়, তার উপর বসা না হয় এবং তার উপর ঘর নির্মাণ করা না হয়”।[10] ইমাম তিরমিযী বলেন: “কবর পাকা করা, তার উপর লিখা, তার উপর নির্মাণ করা এবং তা পায়ে পিষ্ট করতে নিষেধ করেছেন”।[11] নাসাঈর শব্দ হচ্ছে: “কবরের উপর নির্মাণ করা অথবা তার উপর বৃদ্ধি করা অথবা তা পাকা করা অথবা তার উপর লিখা থেকে নিষেধ করেছেন”।[12]
কবরকে সম্মান জানিয়ে দামি বস্তু সেখানে ব্যয় করা শরী‘আতের দৃষ্টিতে বৈধ নয়, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে শুধু এতটুকু প্রমাণিত আছে যে, তিনি কবরের উপর মাটি দিয়েছেন এবং কিছু ছোট পাথর দিয়েছেন যেন মাটি তার উপর বসে যায়, তার অতিরিক্ত করা সীমালঙ্ঘন ও বাড়াবাড়ি। তাই কবরের উপর থেকে শ্রদ্ধা জ্ঞাপনমূলক সকল বস্তু সরিয়ে ফেলার নির্দেশ করেছেন তিনি, হোক সেটা ইট-পাথর, প্লাস্টার, মার্বেল, সিরামিক অথবা কোনো খনিজ দ্রব্য।
মুদ্দাকথা: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শুরুতে কবর যিয়ারত থেকে নিষেধ করেছেন, পরবর্তীতে তার অনুমতি দিয়েছেন হিকমত বর্ণনা করাসহ: “তোমরা কবর যিয়ারত কর, কারণ তা আখেরাত স্মরণ করিয়ে দেয়”।[13] কাদি ইয়াদ বলেন: “উপদেশ গ্রহণ করার নিমিত্তে কবর যিয়ারত করা বৈধ, বড়ত্ব প্রকাশ, প্রতিযোগিতা ও মাতম করার উদ্দেশ্য নয়, যেমন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: “বেহুদা কথা বল না”।[14] কাদি ইয়াদ বলেন: “আখেরাত স্মরণ করিয়ে দেয়া ব্যতীত কবর যিয়ারত করার কোনো কারণ আমি জানি না”।[15]
কীভাবে কবর যিয়ারত করব সেটাও রয়েছে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আদর্শে। আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রাতের শেষাংশে ‘বাকি করবস্থান’-এ যেতেন। সেখানে তিনি বলতেন:
«السلام عليكم دار قوم مؤمنين وأتاكم ما توعدون، غداً  مُؤَجَّلُون وإنّا إن شاء الله بكم لاحقون. اللهم اغفر لأهل بقيع الغرقد»
“হে মুমিনদের বাড়ি-ঘরের অধিবাসীগণ তোমাদের ওপর সালাম, তোমাদের যা ওয়াদা করা হয়েছিল সামনে হাযির হয়েছে, (আমাদের পরিণতিও তোমাদের পরিণতির মতো হবে) তবে আমরা আগামীকাল পর্যন্ত অবকাশ প্রাপ্ত। আর আমরা অবশ্যই আল্লাহর ইচ্ছায় তোমাদের সাথে মিলিত হবো। হে আল্লাহ, তুমি বাকী‘ আল-গারকাদের অধিবাসীদের ক্ষমা কর”।[16] অনুরূপ আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা যখন জানতে চান, কীভাবে কবর যিয়ারত করবেন, তিনি বলেন, বল:
«السلام على أهل الديار من المؤمنين والمسلمين يرحم الله المستقدمين منّا والمستأخرين ، وإنّا إن شاء الله بكم لاحقون . وفي رواية : أسأل الله لنا ولكم العافية» . رواه مسلم
“হে মুমিন ও মুসলিমদের বাড়ি-ঘরের অধিবাসীগণ, আমাদের পূর্ববর্তী ও পরবর্তীদের ওপর আল্লাহ রহম করুন, আমরা অবশ্যই আল্লাহর ইচ্ছায় তোমাদের সাথে মিলিত হবো”। অপর বর্ণনায় এসেছে: “আল্লাহর নিকট আমাদের জন্য ও তোমাদের জন্য নিরাপত্তা প্রার্থনা করছি”।[17]
এভাবে আমাদেরকে তিনি কবর যিয়ারত করার নিয়ম বাতলে দেন; কিন্তু শয়তান মূর্খ ও বিপথগামীদের নিকট শির্ককে সুন্দরভাবে পেশ করে, তারা কবরে গিয়ে বলে: হে আমার সায়্যেদ অমুক (মৃত), আমাকে সাহায্য কর; তার নিকট বিভিন্ন প্রয়োজন পেশ করে, যা কবিরা গুনাহ  ও শির্ক।
অতএব, যে যিয়ারত করবে সে যিয়ারত করার কারণও গ্রহণ করবে অর্থাৎ উপদেশ। আর এটা হাসিল হয় যে কোনো কবর যিয়ারত দ্বারা, নিকট আত্মীয় কিংবা দূর সম্পর্কীয় বলে কোনো কথা নেই। মূল উদ্দেশ্য উপদেশ গ্রহণ করা, মানুষের শেষ পরিণতি মাটির গর্ত ভিন্ন কিছু নয়। মৃত ব্যক্তি মুমিন হলে কবর প্রশস্ত করা হয়, কাফির হলে সংকীর্ণ করা হয়। সুতরাং কবর যিয়ারত করার জন্য দূর কোথাও যাওয়া কিংবা দীর্ঘ সফর করার অর্থ নেই, কারণ যে কোনো কবরের পাশে দাঁড়ালে উপদেশ হাসিল হয়। হ্যাঁ, যদি স্বীয় পিতা, মাতা বা কোনো সন্তানের কবর যিয়ারত করা হয়, তাহলে উপদেশ গ্রহণ গভীর হয়, দলীল আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুর হাদীস, তিনি বলেন: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর মায়ের কবর যিয়ারত করেন, তিনি নিজে কাঁদেন এবং যারা পাশে ছিল তাদের কাঁদান। অতঃপর তিনি বলেন:
«استأذنت ربي أن أستغفر لها فلم يُؤذن لي و استأذنته في أن أزور قبرها فأذن لي ، فزوروا القبور فإنها تذكر الموت».
“আমি আমার রবের নিকট অনুমতি চেয়েছি যে, আমার মায়ের জন্য ইস্তেগফার করব, তিনি আমাকে অনুমতি দেন নি, আমি তার কবর যিয়ারত করার অনুমতি চেয়েছি, তিনি আমাকে তার অনুমতি দেন। অতএব, তোমরা কবর যিয়ারত কর, কারণ তা মৃত্যুকে স্মরণ করিয়ে দেয়”।[18]
কেউ বলতে পারে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উহুদের শহীদদের কবর যিয়ারত করেছেন -এটা কি দীর্ঘ সফর নয়? না, এটা দীর্ঘ সফর নয়। উহুদ মদীনার পাহাড়সমূহ থেকে একটি পাহাড়, উহুদের শহীদদের কবর মদীনার নিকটবর্তী, তার জন্য দীর্ঘ সফর করার প্রয়োজন হয় না, মদীনা থেকে কেউ উহুদ গেলে বলা হয় না সফরে গিয়েছে। দ্বিতীয়তঃ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের নিকট গিয়েছেন মৃত্যুর পূর্বে দো‘আ ও ইস্তেগফার করার উদ্দেশ্যে, যেমন সহীহ বুখারীতে উকবাহ ইবন আমের থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন:
«صلّى رسول الله صلى الله عليه وسلم على قتلى أُحد بعد ثماني سنين كالمودّع للأحياء والأموات … »
“মৃত ও জীবিতদের বিদায় জানানোর মতো রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আট বছর পর উহুদের শহীদদের জন্য দো‘আ করেছেন”।[19]
অনুরূপ তিনি ‘বাকি কবরস্থান’ যিয়ারত করেছেন আল্লাহর নির্দেশে। আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা থেকে বর্ণিত দীর্ঘ হাদীসে রয়েছে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:
«فإنّ جبريل أتاني .. فقال : إنّ ربَّكَ يأمُرُك أنْ تأتيَ أهلَ البقيع فتستغفر لهم»
“জিবরীল আমার নিকট এসে বলেন: আপনার রব আপনাকে নির্দেশ করছেন বাকি‘র অধিবাসীদের নিকট আসুন এবং তাদের জন্য দো‘আ করুন”।[20]
অতএব, উহুদ ও বাকি‘র ব্যাপারে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আদিষ্ট ছিলেন, সেখানে তিনি তাদের জন্য ইস্তেগফার করেন। তাদের থেকে বরকত হাসিল কিংবা নিজের প্রয়োজন পেশ করার জন্য যান নি, সেখানে পৌঁছার জন্য তার দীর্ঘ সফর ও আসবাব-পত্রসহ প্রস্তুতি গ্রহণ ছিল না। কোনো কিতাবে উল্লেখ নেই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইবরাহীম কিংবা মূসা কিংবা কোনো নবীর কবর যিয়ারত করার জন্য দীর্ঘ সফর করেছেন, অথচ তাদের কবরের জায়গা তিনি জানতেন। অনুরূপ কোনো সাহাবী থেকে প্রমাণিত নয় যে, কবর যিয়ারত করার জন্য তারা দীর্ঘ সফর করেছেন। এটা কীভাবে সম্ভব যেখানে তিনি নিজে বলেছেন: “তিনটি মসজিদ ব্যতীত দীর্ঘ সফর করা যাবে না”।[21]
এভাবেই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্বীয় উম্মতকে তাওহীদ বিনষ্টকারী প্রত্যেক বস্তু থেকে সতর্ক করেছেন, সাহাবীগণ তার আদর্শ বাস্তবায়ন করেছেন অক্ষরে অক্ষরে; কিন্তু শয়তান তার পুরনো পদ্ধতি বেছে নেয় মানুষকে পথহারা করার নিমিত্তে নতুন লেভেল দিয়ে, কবরের দিকে ধাবিত করার বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে, ইসলাম থেকে ছিটকে পড়া কিংবা কুমতলব নিয়ে ইসলাম গ্রহণ করা কতিপয় অনুসারীকে দিয়ে মিথ্যা রচনা করে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদীস বলে প্রচার করে, সাথে যুক্ত করা হয় আজগুবি অনেক ফযীলত। কতক নাম মাত্র আলেম না বুঝে সেগুলো প্রচার করে, তাতে বিধৃত মনগড়া ফযীলতের প্রতি উদ্বুদ্ধ করে এবং যারা তার থেকে সতর্ক করে তাদের বিরুদ্ধাচরণে লিপ্ত হয়!
আল্লাহ তা‘আলা ইসলাম সুরক্ষার অংশ হিসেবে তাওহীদের ধারক আলেমদের তাদের পশ্চাতে দাঁড় করিয়ে দেন, তারা উম্মতকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর আরোপ করা মিথ্যাচার সম্পর্কে সতর্ক করেন। বানোয়াট জাল হাদীসসমূহের অসারতা তুলে ধরেন, কুরআন ও সহীহ হাদীসের দাবির সাথে তার বৈপরীত্য প্রমাণ করেন, যেন প্রকৃত মুসলিম ও নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সত্যিকার অনুসারীরা তার আদর্শের ওপর অটল থাকে। বক্ষ্যমাণ পুস্তিকা সে ধারাবাহিকতার অংশ বিশেষ। আল্লাহ আমাদেরকে কুরআন ও সহীহ সুন্নাহর অনুসরণ করার তাওফীক দিন।
নবী জীবনকে আমরা প্রধান দু’টি ভাগে ভাগ করে নেব- মাক্কী জীবন ও মাদানী জীবন। মক্কায় তাঁর জন্ম, বৃদ্ধি ও নবুঅত  লাভ  এবং  মদীনায়  তাঁর  হিজরত,  ইসলামের বাস্তবায়ন ও ওফাত লাভ। অতঃপর প্রথমেই তাঁর বংশ পরিচয় ও জন্ম বৃত্তান্ত।
বংশ পরিচয় :
ইবরাহীম (আঃ)-এর দুই পুত্র ছিলেন ইসমাঈল ও ইসহাক্ব। ইসমাঈলের মা ছিলেন বিবি হাজেরা এবং ইসহাকের মা ছিলেন বিবি সারা। দুই ছেলেই ‘নবী’ হয়েছিলেন। ছোট ছেলে ইসহাক্বের পুত্র ইয়াকূব ও ‘নবী’ ছিলেন এবং তার অপর নাম ছিল ‘ইস্রাঈল’ অর্থ ‘আল্লাহর দাস’। তাঁর বারোটি পুত্রের বংশধরগণের মধ্যে যুগ যুগ ধরে হাযার হাযার নবীর জন্ম হয়। ইউসুফ, মূসা, হারূণ, দাঊদ, সুলায়মান ও ঈসা (আলাইহিমুস সালাম) ছিলেন এই বংশের সেরা নবী ও রাসূল। বলা চলে যে, আদম (আলাইহিস সালাম) হ’তে ইবরাহীম (আলাইহিস সালাম) পর্যন্ত হযরত নূহ ও ইদরীস (আঃ) সহ ৮/৯ জন নবী ছাড়া এক লক্ষ চবিবশ হাযার পয়গম্বরের প্রায় সকলেই ছিলেন ইবরাহীম (আঃ)-এর কনিষ্ঠ পুত্র ইসহাক (আঃ)-এর বংশধর অর্থাৎ বনু ইস্রাঈল। যাদের সর্বশেষ নবী ছিলেন হযরত ঈসা (আঃ)। অন্যদিকে হযরত ইবরাহীম (আঃ)-এর জ্যেষ্ঠ পুত্র ইসমাঈল (আঃ)-এর বংশে একজন মাত্র নবীর জন্ম হয় এবং তিনিই হ’লেন সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবী হযরত মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)। ফলে আদম (আঃ) যেমন ছিলেন মানবজাতির আদি পিতা, নূহ (আঃ) ছিলেন মানব জাতির দ্বিতীয় পিতা, তেমনি ইবরাহীম (আঃ) ছিলেন তাঁর পরবর্তী সকল নবী ও তাঁদের অনুসারী উম্মতে মুসলিমাহর পিতা (হজ্জ ২২/৭৮)। ইবরাহীম (আঃ) আল্লাহর হুকুমে তাঁর দ্বিতীয়া স্ত্রী হাজেরা ও তার পুত্র ইসমাঈলকে মক্কায় রেখে আসেন ও মাঝে-মধ্যে গিয়ে তাদের দেখাশুনা করতেন। তাঁরা সেখানেই আমৃত্যু বসবাস করেন। অন্যদিকে তাঁর প্রথমা স্ত্রী সারা ও তার পুত্র ইসহাক্ব ও অন্যদের নিয়ে তিনি কেন‘আনে (ফিলিস্তীনে) বসবাস করতেন এবং এখানেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন। এভাবে ইবরাহীম (আঃ)-এর দুই পুত্রের মাধ্যমে মক্কা ও ফিলিস্তীন দুই এলাকায় তাওহীদের প্রচার ও প্রসার ঘটে।
কুরআনে বর্ণিত পঁচিশ জন নবীর মধ্যে আদম, নূহ, ইদরীস ও মুহাম্মাদ (ছাঃ) বাদে বাকী ২১ জন নবী ছিলেন বনু ইস্রাঈল এবং একমাত্র মুহাম্মাদ হ’লেন বনু ইসমাঈল। বলা চলে যে, এই বৈমাত্রেয় পার্থক্য উম্মতে মুহাম্মাদীর বিরুদ্ধে ইহুদী-নাছারাদের বিদ্বেষের অন্যতম কারণ ছিল। সেজন্যে তারা চিনতে পেরেও শেষনবীকে মানেনি (বাক্বারাহ ২/১৪৬; আন‘আম ৬/২০)
এক্ষণে আমরা ইবরাহীম বংশের শ্রেষ্ঠ সন্তান মানবজাতির গৌরব মুকুট, বিশ্ব মানবতার মুক্তিদূত সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবী ও রাসূল হযরত মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম-এর জন্ম ও বংশ পরিচয় তুলে ধরব ইনশাআল্লাহ।
জন্ম ও মৃত্যু :
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ১ম হস্তীবর্ষের ৯ই রবীউল আউয়াল সোমবার ছুবহে ছাদিকের পর মক্কায় জন্মগ্রহণ করেন এবং ১১ হিজরী সনের ১২ই রবীউল আউয়াল সোমবার সকালে ৯/১০টার দিকে চান্দ্র বর্ষের হিসাবে ৬৩ বছর ৪দিন বয়সে মদীনায় মৃত্যুবরণ করেন। সৌরবর্ষ হিসাবে জন্ম ৫৭১ খৃষ্টাব্দের ২২শে এপ্রিল সোমবার এবং মৃত্যু ৬৩২ খৃষ্টাব্দের ৬ই জুন সোমবার। বয়স ৬১ বছর ১ মাস ১৪ দিন। তাঁর জন্ম হয়েছিল আবরাহা কর্তৃক কা‘বা আক্রমণের ৫০ অথবা ৫৫ দিন পরে। এটা ছিল ইবরাহীম (আঃ) থেকে ২৫৮৫ বছর ৭ মাস ২০ দিন পরের এবং নূহের তূফানের ৩৬৭৫ বছর পরের ঘটনা। রাসূল (ছাঃ) দুনিয়াতে বেঁচে ছিলেন মোট ২২,৩৩০ দিন ৬ ঘণ্টা। তন্মধ্যে তাঁর নবুঅত কাল ছিল ৮১৫৬ দিন। এ হিসাব হ’ল সুলায়মান মানছূরপুরীর। সঠিক হিসাব আল্লাহ জানেন।
বংশ : তিনি মক্কার কুরায়েশ বংশের শ্রেষ্ঠ শাখা হাশেমী গোত্রে জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম ছিল আব্দুল্লাহ, মাতার নাম আমেনা, দাদার নাম আব্দুল মুত্ত্বালিব, দাদীর নাম ফাতেমা। নানার নাম ওয়াহাব, নানীর নাম বাররাহ। নানার বংশসূত্র রাসূলের ঊর্ধ্বতন দাদা কিলাব-এর সাথে এবং নানীর বংশসূত্র কুছাই-এর সাথে যুক্ত হয়েছে। নানা ওয়াহাব বনু যোহরা গোত্রের সরদার ছিলেন। দাদার হাশেমী গোত্র ও নানার যোহরা গোত্র কুরায়েশ বংশের দুই বৃহৎ ও সম্ভ্রান্ত গোত্র হিসাবে প্রসিদ্ধ ছিল।
বংশধারা (শাজারাহ) :
তাঁর বংশধারাকে তিনভাগে ভাগ করা যায়। ১ম ভাগে মুহাম্মাদ (ছাঃ) হ’তে ঊর্ধ্বতন পুরুষ আদনান পর্যন্ত ২২টি স্তর। যে ব্যাপারে কারু কোন মতভেদ নেই। এর উপরে ২য় ভাগে আদনান থেকে ইবরাহীম (আঃ) পর্যন্ত ৪১টি স্তর এবং তার উপরে তৃতীয় ভাগে ইবরাহীম (আঃ) হ’তে আদম (আঃ) পর্যন্ত ১৯টি স্তর। যেখানে নাম ও স্তরের ব্যাপারে বিদ্বানগণের মতভেদ রয়েছে। আমরা নিম্নে আদনান পর্যন্ত বংশধারা উল্লেখ করলাম।-
(১) মুহাম্মাদ বিন (২) আব্দুল্লাহ বিন (৩) আব্দুল মুত্ত্বালিব বিন (৪) হাশেম বিন (৫) আবদে মানাফ বিন (৬) কুছাই বিন (৭) কিলাব বিন (৮) মুররাহ বিন (৯) কা‘ব বিন (১০) লুওয়াই বিন (১১) গালিব বিন (১২) ফিহর (লকব কুরায়েশ) বিন (১৩) মালেক বিন (১৪) নাযার বিন (১৫) কানানাহ বিন (১৬) খুযায়মা বিন (১৭) মুদরেকাহ বিন (১৮) ইলিয়াস বিন (১৯) মুযার বিন (২০) নাযার বিন (২১) মা‘দ বিন (২২) আদনান। এর মধ্যে পরদাদা হাশেম-এর নামে হাশেমী গোত্র এবং দ্বাদশতম পুরুষ ফিহর যার উপাধি ছিল কুরায়েশ, তার নামানুসারে কুরায়েশ বংশ প্রসিদ্ধি লাভ করে। কুরায়েশ অর্থ সাগরের তিমি মাছ। ইয়ামনের বাদশাহ হাসসান মক্কা আক্রমণ করে কা‘বা উঠিয়ে নিজ দেশে নিয়ে যেতে চেয়েছিল। ফিহর তাকে যুদ্ধে হারিয়ে তিন বছর বন্দী করে রাখেন। অতঃপর তাকে মুক্তি দেন। হাসসান ইয়ামনে ফেরার পথে রাস্তায় মারা যায়। এই ঘটনার পর থেকে ফিহর ‘আরবের কুরায়েশ’ বলে খ্যাতি লাভ করেন’।  রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) স্বীয় বংশ সম্পর্কে বলেন,
إن الله اصطفى من ولد إبراهيم إسماعيل واصطفى من ولد إسماعيل بني كنانة واصطفى من بني كنانة قريشا واصطفى من قريش بني هاشمٍ واصطفاني من بني هاشم، رواه مسلم عن واثلة بن الأسقع.
‘আল্লাহ ইবরাহীমের সন্তানগণের মধ্য থেকে ইসমাঈলকে বেছে নিয়েছেন। অতঃপর ইসমাঈলের সন্তানগণের মধ্য থেকে বনু কানানাহকে বেছে নিয়েছেন। অতঃপর বনু কানানাহ থেকে কুরায়েশ বংশকে বেছে নিয়েছেন। অতঃপর কুরায়েশ থেকে বনু হাশেমকে এবং বনু হাশেম থেকে আমাকে বেছে নিয়েছেন।[1]
শুধু তাই নয়, তিনি বলতেন, আমি আমার পিতা ইবরাহীমের দো‘আ ও ঈসার সুসংবাদ (এর ফসল)’।[2]কেননা ইবরাহীম ও ইসমাঈল বায়তুল্লাহ নির্মাণের সময় দো‘আ করেছিলেন, যা কুরআনে বর্ণিত হয়েছে নিম্নোক্ত ভাষায়-
رَبَّنَا وَابْعَثْ فِيْهِمْ رَسُوْلاً مِّنْهُمْ يَتْلُو عَلَيْهِمْ آيَاتِكَ وَيُعَلِّمُهُمُ الْكِتَابَ وَالْحِكْمَةَ وَيُزَكِّيْهِمْ إِنَّكَ أَنْتَ الْعَزِيْزُ الْحَكِيْمُ-
‘হে আমাদের পালনকর্তা! আপনি তাদের মধ্য হ’তে একজনকে তাদের মধ্যে রাসূল হিসাবে প্রেরণ করুন, যিনি তাদের নিকটে আপনার আয়াত সমূহ পাঠ করে শুনাবেন এবং তাদেরকে কিতাব ও হিকমত (সুন্নাহ) শিক্ষা দিবেন ও তাদেরকে পরিশুদ্ধ করবেন’ (বাক্বারাহ ২/১২৯)
পিতা-পুত্রের এই মিলিত দো‘আ দুই হাযারের অধিক বছর পরে  শেষনবী  মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর  আগমনের  মাধ্যমে বাস্তবে রূপ লাভ করে।
একইভাবে ঈসা (আঃ) স্বীয় কওমকে উদ্দেশ্য করে শেষনবী আগমনের সুসংবাদ দিয়ে বলেছিলেন, যেমন আল্লাহ বলেন,
وَإِذْ قَالَ عِيسَى ابْنُ مَرْيَمَ يَا بَنِي إِسْرَائِيلَ إِنِّي رَسُولُ اللَّهِ إِلَيْكُم مُّصَدِّقاً لِّمَا بَيْنَ يَدَيَّ مِنَ التَّوْرَاةِ وَمُبَشِّراً بِرَسُولٍ يَأْتِي مِن بَعْدِي اسْمُهُ أَحْمَدُ فَلَمَّا جَاءهُم بِالْبَيِّنَاتِ قَالُوا هَذَا سِحْرٌ مُّبِينٌ-
‘স্মরণ কর, যখন মরিয়ম-তনয় ঈসা বলেছিল, হে বনু ইস্রাঈলগণ! আমি তোমাদের কাছে আল্লাহর প্রেরিত রাসূল, আমার পূর্ববর্তী তওরাতের আমি সত্যয়নকারী এবং আমি এমন একজন রাসূলের সুসংবাদদাতা, যিনি আমার পরে আগমন করবেন, তার নাম আহমাদ…’ (ছফ ৬১/৬)
পিতা আব্দুল্লাহ বিন আব্দুল মুত্ত্বালিব ব্যবসায়ের উদ্দেশ্যে পিতার হুকুমে ইয়াছরিব (মদীনা) গেলে সেখানে অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং মাত্র ২৫ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন ও সেখানে নাবেগা জা‘দীর গোত্রে সমাধিস্থ হন। এভাবে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর জন্মের পূর্বে তাঁর পিতার মৃত্যু হয়ে যায়।
খাৎনা ও নামকরণ :
প্রচলিত প্রথা মোতাবেক সপ্তম দিনে নবজাতকের খাৎনা ও নামকরণ করা হয়। পিতৃহীন নবজাতককে কোলে নিয়ে স্নেহশীল দাদা আব্দুল মুত্ত্বালিব কা‘বা গৃহে প্রবেশ করেন। তিনি সেখানে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করেন ও প্রাণভরে দো‘আ করেন। আক্বীক্বার দিন সমস্ত কুরায়েশ বংশের লোককে দাওয়াত করে খাওয়ান। সকলে জিজ্ঞেস করলে তিনি বাচ্চার নাম বলেন, ‘মুহাম্মাদ’। এই অপ্রচলিত নাম শুনে লোকেরা এর কারণ জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, আমি চাই যে, আমার বাচ্চা সারা দুনিয়ায় ‘প্রশংসিত’ হৌক। ওদিকে স্বপ্নের মাধ্যমে ফেরেশতার দেওয়া প্রস্তাব অনুযায়ী মা আমেনা তার নাম রাখেন ‘আহমাদ’। উভয় নামের অর্থ প্রায় একই। অর্থাৎ ‘প্রশংসিত’ এবং ‘সর্বাধিক প্রশংসিত’। উভয় নামই কুরআনে এসেছে। যেমন ‘মুহাম্মাদ’ নাম এসেছে চার জায়গায়। যথাক্রমে- সূরা আলে ইমরান ৩/১৪৪, আহযাব ৩৩/৪০; মুহাম্মাদ ৪৭/২ এবং ফাৎহ ৪৮/২৯। তাছাড়া ‘মুহাম্মাদ’ নামেই একটি সূরা নাযিল হয়েছে সূরা মুহাম্মাদ (৪৭ নং)। অনুরূপভাবে ‘আহমাদ’ নাম এসেছে এক জায়গায় (ছফ ৬১/৬)
কথিত আছে যে, (১) রাসূল খাৎনা করা অবস্থায় জামা-পাজামা পরে ভূমিষ্ট হয়েছিলেন, যাতে কেউ তার লজ্জাস্থান দেখতে না পায়। (২) এছাড়াও কথিত আছে যে, জান্নাত থেকে আসিয়া ও মারিয়াম নেমে এসে ধাত্রীর কাজ করেন। (৩) আরও কথিত আছে যে, রাসূলের জন্মের সংবাদ শুনে চাচা আবু লাহাব আনন্দে আত্মহারা হয়ে মক্কার অলি-গলিতে এই সুসংবাদ শুনানোর জন্য দৌড়ে যান এবং তাকে প্রথম সংবাদ দানকারিণী দাসী ছুওয়াইবাকে খুশীর নিদর্শন স্বরূপ মুক্ত করে দেন। মীলাদের মজলিসে আরও বলা হয়ে থাকে যে, রাসূল জন্মের সংবাদ দেবার সময় আবু লাহাবের শাহাদাত অঙ্গুলী উঁচু ছিল বিধায় খুশীতে সেটি জাহান্নামের আগুন থেকে নিরাপদ থাকবে। বলা বাহুল্য, এসবই ভিত্তিহীন কল্প কথা মাত্র। (৪) বিশ্বসেরা জীবনীগ্রন্থ হিসাবে পুরস্কারপ্রাপ্ত আর-রাহীকুল মাখতূমেও কিছু অশুদ্ধ বর্ণনা উদ্ধৃত হয়েছে, যা উক্ত গ্রন্থের উচ্চ মর্যাদাকে ক্ষুণ্ণ করেছে। যেমন (ক) রাসূল জন্মের সময় তার মা বলছেন যে, আমার গুপ্তাঙ্গ দিয়ে ‘নূর’ অর্থাৎ জ্যোতি বিকশিত হয়েছিল। যা সিরিয়ার প্রাসাদ সমূহকে আলোকিত করেছিল (খ) পারস্যের কিসরা রাজপ্রাসাদের ১৪টি চূড়া ভেঙ্গে পড়েছিল (গ) অগ্নি উপাসক মজূসীদের পূজার আগুন নিভে গিয়েছিল (ঘ) বাহীরাহর পার্শ্ববর্তী গীর্জাসমূহ ধ্বসে পড়েছিল ইত্যাদি (পৃঃ ৫৪)। উল্লেখ্য যে, অনুবাদক তার অগণিত ভুল অনুবাদের মধ্যে ঐ সাথে এটাও যোগ করেছেন যে, (ঙ) ঐ সময় কা‘বা গৃহের ৩৬০টি মূর্তি ভূলুণ্ঠিত হয়ে পড়ে’ (পৃঃ ৭৬), প্রকাশক: তাওহীদ পাবলিকেশন্স, ঢাকা সেপ্টেম্বর ২০০৯)
রাসূলের নাম সমূহ :
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, إن لى أسماء أنا محمد وأنا أحمد وأنا الماحي الذي محا الله بي الكفر وأنا الحاشر الذي يحشر الناس على قدمي وأنا العاقب الذي لا نبي بعدي، رواه مسلم عن جبير بن مطعم- ‘আমার কয়েকটি নাম রয়েছে। আমি মুহাম্মাদ (প্রশংসিত), আমি আহমাদ (সর্বাধিক প্রশংসিত), আমি ‘মাহী’ (বিদূরিতকারী) আমার মাধ্যমে আল্লাহ কুফরীকে বিদূরিত করেছেন। আমি ‘হাশের’ (জমাকারী) কেননা সমস্ত লোক ক্বিয়ামতের দিন আমার কাছে জমা হবে (এবং শাফা‘আতের জন্য অনুরোধ করবে)। আমি ‘আক্বেব’ (সর্বশেষে আগমনকারী) আমার পরে আর কোন নবী নেই’।[3]
সুলায়মান মানছূরপুরী বলেন, উক্ত নাম সমূহের মধ্যে মুহাম্মাদ ও আহমাদ হ’ল তাঁর মূল নাম এবং বাকীগুলো হ’ল তাঁর গুণবাচক নাম। সেজন্য তিনি সেগুলির ব্যাখ্যা করেছেন। এই গুণবাচক নামের সংখ্যা মানছূরপুরী গণনা করেছেন ৫৪টি। তিনি ৯২টি করার আশাবাদ ব্যক্ত করেছিলেন।
(ক) রাসূলের মৃত্যুর পরে কন্যা ফাতেমার শোকগাথাতেও ‘আহমাদ’ নাম এসেছে। যেমন-
صُبَّتْ عَلَيَّ مَصَائِبُ لَوْ أنَّهَا * صُبَّتْ عَلَى الْأَيَّامِ صِرنَ لَيَالِيَا
مَاذَا عَلَى مَنْ شَمَّ تُرْبَةَ أحْمَدَ * أنْ لاَ يَشَمَّ مُدَى الزَّمَانِ غَوَالِيَا
(১) আমার উপরে এমন বিপদ আপতিত হয়েছে, যদি তা দিনের উপরে পড়ত, তবে তা রাতে পরিণত হয়ে যেত।
(২) যে কেউ আহমাদের কবরের মাটি শুঁকবে, তার উপরে ওয়াজিব হবে যে সে সারাটি জীবনে আর কোন সুগন্ধি শুঁকবে না’।
এমনি ভাবে কট্টরপন্থী খারেজীরা যখন আলী (রাঃ)-কে নতুনভাবে তাদের সামনে ঈমান আনতে ও ইসলামে দাখিল হ’তে বলে, তখন তিনি দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে বলেছিলেন,
يا شاهد الخير عليَّ فاشهد * إني على دين النبي أحمد
مَنْ شَكَّ في الله فإني مهتدي-
‘আমার উপরে হে কল্যাণের সাক্ষী সাক্ষী থাক, নিশ্চয়ই আমি নবী আহমাদের দ্বীনের উপরে রয়েছি, আল্লাহর ব্যাপারে যে সন্দেহ পোষণ করে সে জেনে রাখুক যে, আমি হেদায়াত প্রাপ্ত’। উল্লেখ্য যে, চরমপন্থী খারেজীরা আলী (রাঃ)-কে ‘কাফের’ ফৎওয়া দিয়ে তাঁকে ফজরের জামা‘আতে মসজিদে যাওয়ার সময় মর্মান্তিকভাবে হত্যা করেছিল এবং হত্যাকারী আব্দুর রহমান নির্বিকারভাবে সেখানে দাঁড়িয়ে থেকে লোকদের উদ্দেশ্যে বলেছিল, ‘আমি খুবই আনন্দিত এজন্য যে, আমি আজ ‘আল্লাহর নিকৃষ্টতম সৃষ্টি’-কে হত্যা করেছি’।
(খ) ওদিকে ‘মুহাম্মাদ’ নামের প্রশংসায় কবি হাসসান বিন ছাবেত আনছারী (রাঃ) গেয়েছেন-
وَشقَّ له من اسمه لِيُجِلَّهُ * فذو العرش محمود وهذا محمد
‘তাঁর মর্যাদা বৃদ্ধির জন্য আল্লাহ নিজের নাম থেকে তার নাম বের করেছেন। তাই আরশের মালিক হ’লেন মাহমূদ এবং ইনি হ’লেন মুহাম্মাদ’।
উল্লেখ্য যে, ক্বিয়ামতের দিন রাসূলের শাফা‘আতের স্থানের নাম হবে ‘মাক্বামে মাহমূদ’।
আল্লাহ বলেন, ‘..মানুষ হ’ল সবচেয়ে বেশী ঝগড়া প্রিয়’ (কাহফ ১৮/৫৪) । তিনি বলেন, ‘যদি তোমার প্রতিপালক চাইতেন, তবে সকল মানুষকে একই দলভুক্ত করতেন। কিন্তু তারা সর্বদা মতভেদ করতেই থাকবে’। ‘কেবল তারা ব্যতীত যাদের উপর তোমার পালনকর্তা অনুগ্রহ করেন..’ (হূদ ১১/১১৮-১৯) । মানুষ কেবল দুনিয়াতেই ঝগড়া করবে না, ক্বিয়ামতের দিনও আল্লাহর সামনে ঝগড়া করবে। যেমন তিনি বলেন, ‘অতঃপর ক্বিয়ামতের দিন তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের সামনে আপোষে ঝগড়া করবে’ (যুমার ৩৯/৩১) । এর দ্বারা কাফির-মুমিন ও যালেম-মযলূম সবাইকে বুঝানো হয়েছে। কেননা দুনিয়াতে এদের ঝগড়া মিটবে না। আল্লাহর সামনে গিয়েও এরা ঝগড়া করবে এবং প্রত্যেকে নিজের পক্ষে ছাফাই গাইবে। কে না জানে যে, জীবনের বিপরীত হ’ল মৃত্যু। যখন তার আর কিছুই করার ক্ষমতা থাকেনা। অথচ এমন একটি অবিসংবাদিত সত্য বিষয় নিয়েও মানুষ ঝগড়া করে। আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয়ই তুমি মৃত্যুবরণ করবে এবং তারাও মৃত্যুবরণ করবে’ (যুমার ৩৯/৩০) । আয়াতটি কুরআনের মৌলিক আয়াত সমূহের অন্যতম। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর মৃত্যুর পর আবুবকর (রাঃ) শোকাহত ছাহাবীদের সামনে এই আয়াতটি পাঠ করেই তাদের শান্ত করেছিলেন। সেই সাথে তিনি আলে ইমরান ১৪৪ আয়াতটিও পাঠ করেছিলেন (বুখারী হা/৩৬৬৮) । কিন্তু যুগে যুগে মূর্তিপূজারীরা মূর্তির মধ্যে জীবনের কল্পনা করেছে। অন্যদিকে মারেফতী নামধারী কিছু লোক রাসূল (ছাঃ)-এর বরযখী জীবনকে দুনিয়াবী জীবনের সাথে তুলনা করে তিনি কবরে সবকিছু শুনতে পান ও মানুষের ভাল-মন্দ করতে পারেন বলে ধারণা করেন। সেই সাথে ‘পীর-আউলিয়ারা মরেন না’ বলে মিথ্যা প্রচার করেন। অথচ আল্লাহ এদের ঝগড়া অবশ্যই মিটাবেন সূক্ষ্ম বিচারের মাধ্যমে। তিনি বলেন, ‘নিশ্চয়ই তোমার প্রতিপালক ক্বিয়ামতের দিন তাদের মতভেদের বিষয়গুলিতে তাদের মধ্যে ফায়ছালা করে দিবেন’ (সাজদাহ ৩২/২৫) ।
তিনি বলেন, ‘আর মানুষের মধ্যে কিছু লোক এমন রয়েছে, যারা অন্যকে আল্লাহর সমকক্ষ সাব্যস্ত করে। তারা তাদেরকে ভালোবাসে আল্লাহকে ভালোবাসার ন্যায়। কিন্তু যারা ঈমানদার তারা আল্লাহর জন্য সর্বাধিক ভালোবাসা পোষণ করে থাকে…। ‘আর (স্মরণ কর) যেদিন অনুসরণীয়গণ তাদের অনুসারীদের থেকে পৃথক হয়ে যাবে এবং তারা আযাবকে প্রত্যক্ষ করবে ও পরস্পরের সকল সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যাবে’। ‘(সেদিন) অনুসারীরা বলবে, যদি আমাদের (পৃথিবীতে) ফিরে যাওয়ার সুযোগ হ’ত, তাহ’লে আমরা তাদের থেকে পৃথক হয়ে যেতাম, যেমন তারা (আজ) আমাদের থেকে পৃথক হয়ে গেছে। এভাবেই আল্লাহ তাদের কৃতকর্ম সমূহকে তাদের জন্য অনুতাপ হিসাবে দেখাবেন। আর তারা কখনোই জাহান্নাম থেকে বের হ’তে পারবে না’ (বাক্বারাহ ২/১৬৫-৬৭) ।
সেদিন ‘তাদেরকে তোমার প্রতিপালকের সম্মুখে হাযির করা হবে সারিবদ্ধভাবে…, ‘অতঃপর পেশ করা হবে আমলনামা। তখন তাতে যা আছে তার কারণে তুমি অপরাধীদের দেখবে আতংকগ্রস্ত। তারা বলবে, হায় আফসোস! এটা কেমন আমলনামা যে, ছোট-বড় কোন কিছুই ছাড়েনি, সবকিছুই গণনা করেছে? আর তারা তাদের কৃতকর্ম সামনে উপস্থিত পাবে। বস্ত্ততঃ তোমার প্রতিপালক কাউকে যুলুম করেন না’ (কাহফ ১৮/৪৮-৪৯) । তিনি বলেন, ‘…আর ক্বিয়ামতের দিন আমরা তাকে বের করে দেখাব একটি আমলনামা, যা সে খোলা অবস্থায় পাবে’। ‘(সেদিন আমরা বলব,) তুমি তোমার আমলনামা পাঠ কর। আজ তুমি নিজেই নিজের হিসাবের জন্য যথেষ্ট’। ‘যে ব্যক্তি সৎপথ অবলম্বন করে, সে তার নিজের মঙ্গলের জন্যেই সেটা করে। আর যে ব্যক্তি পথভ্রষ্ট হয়, সে তার নিজের ধ্বংসের জন্যেই সেটা হয়। বস্ত্ততঃ একের বোঝা অন্যে বহন করে না। আর আমরা রাসূল না পাঠানো পর্যন্ত কাউকে শাস্তি দেই না’
(ইসরা ১৭/১৩-১৫) । ‘যেদিন অবিশ্বাসীদের জাহান্নামের দিকে দলে দলে হাঁকিয়ে নেওয়া হবে। অতঃপর যখন তারা জাহান্নামের কিনারে এসে উপস্থিত হবে ও তার দরজা সমূহ খুলে দেওয়া হবে, তখন তার দাররক্ষীরা বলবে, তোমাদের নিকটে কি তোমাদের মধ্য থেকে রাসূলগণ আসেন নি?… তারা বলবে, অবশ্যই এসেছিলেন।… বলা হবে, তোমরা জাহান্নামে প্রবেশ কর স্থায়ীভাবে। কতইনা নিকৃষ্ট আবাসস্থল এটি অহংকারীদের জন্য’
(যুমার ৩৯/৭১-৭২) । সেদিন বাম হাতে আমলনামা প্রাপ্তরা বলবে, ‘হায় যদি আমাকে আজ আমলনামা না দেওয়া হ’ত’! ‘হায় যদি আমি আমার হিসাব জানতে না পারতাম’! ‘আজ আমার ধন-সম্পদ কোন কাজে লাগল না’! ‘আমার রাজনৈতিক ক্ষমতা আজ ধ্বংস হয়ে গেছে’! ‘এ সময় বলা হবে, ওকে ধর’। ‘অতঃপর ওকে বেড়ীবদ্ধ কর’। ‘অতঃপর ওকে জাহান্নামে নিক্ষেপ কর’। ‘অতঃপর সত্তুর হাত লম্বা শিকল দিয়ে ওকে শক্ত করে বেঁধে ফেল’ (হাক্কাহ ৬৯/২৫-৩২) ।
‘সেদিন তারা বলবে, হায়! যদি আমরা আল্লাহকে মানতাম ও রাসূলকে মানতাম’! ‘তারা আরও বলবে, হে আমাদের প্রতিপালক! আমরা আমাদের নেতাদের ও বড়দের আনুগত্য করতাম। অতঃপর তারাই আমাদের পথভ্রষ্ট করেছিল’। ‘হে আমাদের প্রতিপালক! তাদেরকে তুমি দ্বিগুণ শাস্তি দাও এবং তাদেরকে মহা অভিশাপ দাও’ (আহযাব ৩৩/৬৬-৬৮) । আল্লাহ বলেন, ‘…সেদিন পাপীদের জন্য কোন সুসংবাদ থাকবে না। তারা বলবে, বাঁচাও বাঁচাও’। ‘আর আমরা সেদিন তাদের কৃতকর্মসমূহের দিকে মনোনিবেশ করব। অতঃপর সেগুলিকে বিক্ষিপ্ত ধূলিকণায় পরিণত করব’ (ফুরক্বান ২৫/২২-২৩) । ‘যালেম সেদিন নিজের দু’হাত কামড়ে বলবে, হায়! যদি (দুনিয়াতে) রাসূলের পথ অবলম্বন করতাম’। ‘হায় দুর্ভোগ! যদি আমি অমুককে বন্ধুরূপে গ্রহণ না করতাম’! ‘আমার কাছে উপদেশ (কুরআন) আসার পর সে আমাকে পথভ্রষ্ট করেছিল। বস্ত্ততঃ শয়তান মানুষের জন্য পথভ্রষ্টকারী’। ‘সেদিন রাসূল বলবেন, হে আমার প্রতিপালক! নিশ্চয়ই আমার উম্মত এই কুরআনকে পরিত্যাজ্য গণ্য করেছিল’। ‘এভাবেই আমরা প্রত্যেক নবীর জন্য অপরাধীদের মধ্য থেকে শত্রু করেছি। আর তোমার জন্য পথপ্রদর্শক ও সাহায্যকারী হিসাবে তোমার পালনকর্তাই যথেষ্ট’ (ফুরক্বান ২৫/২৭-৩১) ।
‘(সেদিন) জান্নাতবাসীরা জাহান্নামবাসীদের (উপহাস করে) বলবে, আমাদের প্রতিপালক আমাদের যেসব প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, সবই আমরা যথার্থভাবে পেয়েছি। এখন তোমরা কি তোমাদের প্রতিপালকের দেওয়া প্রতিশ্রুতি যথার্থভাবে পেয়েছ? তারা বলবে, হ্যাঁ। অতঃপর একজন ঘোষক উভয় দলের মধ্যে ঘোষণা করে বলবে, যালিমদের উপর আল্লাহর অভিসম্পাৎ’। ‘তারা আল্লাহর পথ থেকে মানুষকে বাধা দিত এবং তাতে বক্রতা খুঁজে বেড়াত। আর তারা আখেরাতকে অস্বীকার করত’ (আ‘রাফ ৭/৪৪-৪৫) ।
অতঃপর মানব জাতির প্রতি সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর নাযিলকৃত সর্বশেষ আয়াত, ‘আর তোমরা ঐ দিনকে ভয় কর, যেদিন তোমরা সকলে আল্লাহর নিকটে ফিরে যাবে। আর সেদিন প্রত্যেকে স্ব স্ব কর্মের ফল পুরোপুরি পাবে এবং তাদের প্রতি কোনরূপ অবিচার করা হবে না’ (বাক্বারাহ ২/২৮১) । তালাবদ্ধ হৃদয় সমূহে কুরআনের উপরোক্ত বাণীগুলি করাঘাত করবে কি?

আল্লাহর সামনে ঝগড়া

                                                    বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম
                                         পরম করুনময় আল্লাহর নাম সরন করি
                                                   সগ্রহকারি মোঃ রোকন সরকার

আল্লাহ বলেন, ‘..মানুষ হ’ল সবচেয়ে বেশী ঝগড়া প্রিয়’ (কাহফ ১৮/৫৪) । তিনি বলেন, ‘যদি তোমার প্রতিপালক চাইতেন, তবে সকল মানুষকে একই দলভুক্ত করতেন। কিন্তু তারা সর্বদা মতভেদ করতেই থাকবে’। ‘কেবল তারা ব্যতীত যাদের উপর তোমার পালনকর্তা অনুগ্রহ করেন..’ (হূদ ১১/১১৮-১৯) । মানুষ কেবল দুনিয়াতেই ঝগড়া করবে না, ক্বিয়ামতের দিনও আল্লাহর সামনে ঝগড়া করবে। যেমন তিনি বলেন, ‘অতঃপর ক্বিয়ামতের দিন তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের সামনে আপোষে ঝগড়া করবে’ (যুমার ৩৯/৩১) । এর দ্বারা কাফির-মুমিন ও যালেম-মযলূম সবাইকে বুঝানো হয়েছে। কেননা দুনিয়াতে এদের ঝগড়া মিটবে না। আল্লাহর সামনে গিয়েও এরা ঝগড়া করবে এবং প্রত্যেকে নিজের পক্ষে ছাফাই গাইবে। কে না জানে যে, জীবনের বিপরীত হ’ল মৃত্যু। যখন তার আর কিছুই করার ক্ষমতা থাকেনা। অথচ এমন একটি অবিসংবাদিত সত্য বিষয় নিয়েও মানুষ ঝগড়া করে। আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয়ই তুমি মৃত্যুবরণ করবে এবং তারাও মৃত্যুবরণ করবে’ (যুমার ৩৯/৩০) । আয়াতটি কুরআনের মৌলিক আয়াত সমূহের অন্যতম। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর মৃত্যুর পর আবুবকর (রাঃ) শোকাহত ছাহাবীদের সামনে এই আয়াতটি পাঠ করেই তাদের শান্ত করেছিলেন। সেই সাথে তিনি আলে ইমরান ১৪৪ আয়াতটিও পাঠ করেছিলেন (বুখারী হা/৩৬৬৮) । কিন্তু যুগে যুগে মূর্তিপূজারীরা মূর্তির মধ্যে জীবনের কল্পনা করেছে। অন্যদিকে মারেফতী নামধারী কিছু লোক রাসূল (ছাঃ)-এর বরযখী জীবনকে দুনিয়াবী জীবনের সাথে তুলনা করে তিনি কবরে সবকিছু শুনতে পান ও মানুষের ভাল-মন্দ করতে পারেন বলে ধারণা করেন। সেই সাথে ‘পীর-আউলিয়ারা মরেন না’ বলে মিথ্যা প্রচার করেন। অথচ আল্লাহ এদের ঝগড়া অবশ্যই মিটাবেন সূক্ষ্ম বিচারের মাধ্যমে। তিনি বলেন, ‘নিশ্চয়ই তোমার প্রতিপালক ক্বিয়ামতের দিন তাদের মতভেদের বিষয়গুলিতে তাদের মধ্যে ফায়ছালা করে দিবেন’ (সাজদাহ ৩২/২৫) ।
তিনি বলেন, ‘আর মানুষের মধ্যে কিছু লোক এমন রয়েছে, যারা অন্যকে আল্লাহর সমকক্ষ সাব্যস্ত করে। তারা তাদেরকে ভালোবাসে আল্লাহকে ভালোবাসার ন্যায়। কিন্তু যারা ঈমানদার তারা আল্লাহর জন্য সর্বাধিক ভালোবাসা পোষণ করে থাকে…। ‘আর (স্মরণ কর) যেদিন অনুসরণীয়গণ তাদের অনুসারীদের থেকে পৃথক হয়ে যাবে এবং তারা আযাবকে প্রত্যক্ষ করবে ও পরস্পরের সকল সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যাবে’। ‘(সেদিন) অনুসারীরা বলবে, যদি আমাদের (পৃথিবীতে) ফিরে যাওয়ার সুযোগ হ’ত, তাহ’লে আমরা তাদের থেকে পৃথক হয়ে যেতাম, যেমন তারা (আজ) আমাদের থেকে পৃথক হয়ে গেছে। এভাবেই আল্লাহ তাদের কৃতকর্ম সমূহকে তাদের জন্য অনুতাপ হিসাবে দেখাবেন। আর তারা কখনোই জাহান্নাম থেকে বের হ’তে পারবে না’ (বাক্বারাহ ২/১৬৫-৬৭) ।
সেদিন ‘তাদেরকে তোমার প্রতিপালকের সম্মুখে হাযির করা হবে সারিবদ্ধভাবে…, ‘অতঃপর পেশ করা হবে আমলনামা। তখন তাতে যা আছে তার কারণে তুমি অপরাধীদের দেখবে আতংকগ্রস্ত। তারা বলবে, হায় আফসোস! এটা কেমন আমলনামা যে, ছোট-বড় কোন কিছুই ছাড়েনি, সবকিছুই গণনা করেছে? আর তারা তাদের কৃতকর্ম সামনে উপস্থিত পাবে। বস্ত্ততঃ তোমার প্রতিপালক কাউকে যুলুম করেন না’ (কাহফ ১৮/৪৮-৪৯) । তিনি বলেন, ‘…আর ক্বিয়ামতের দিন আমরা তাকে বের করে দেখাব একটি আমলনামা, যা সে খোলা অবস্থায় পাবে’। ‘(সেদিন আমরা বলব,) তুমি তোমার আমলনামা পাঠ কর। আজ তুমি নিজেই নিজের হিসাবের জন্য যথেষ্ট’। ‘যে ব্যক্তি সৎপথ অবলম্বন করে, সে তার নিজের মঙ্গলের জন্যেই সেটা করে। আর যে ব্যক্তি পথভ্রষ্ট হয়, সে তার নিজের ধ্বংসের জন্যেই সেটা হয়। বস্ত্ততঃ একের বোঝা অন্যে বহন করে না। আর আমরা রাসূল না পাঠানো পর্যন্ত কাউকে শাস্তি দেই না’
(ইসরা ১৭/১৩-১৫) । ‘যেদিন অবিশ্বাসীদের জাহান্নামের দিকে দলে দলে হাঁকিয়ে নেওয়া হবে। অতঃপর যখন তারা জাহান্নামের কিনারে এসে উপস্থিত হবে ও তার দরজা সমূহ খুলে দেওয়া হবে, তখন তার দাররক্ষীরা বলবে, তোমাদের নিকটে কি তোমাদের মধ্য থেকে রাসূলগণ আসেন নি?… তারা বলবে, অবশ্যই এসেছিলেন।… বলা হবে, তোমরা জাহান্নামে প্রবেশ কর স্থায়ীভাবে। কতইনা নিকৃষ্ট আবাসস্থল এটি অহংকারীদের জন্য’
(যুমার ৩৯/৭১-৭২) । সেদিন বাম হাতে আমলনামা প্রাপ্তরা বলবে, ‘হায় যদি আমাকে আজ আমলনামা না দেওয়া হ’ত’! ‘হায় যদি আমি আমার হিসাব জানতে না পারতাম’! ‘আজ আমার ধন-সম্পদ কোন কাজে লাগল না’! ‘আমার রাজনৈতিক ক্ষমতা আজ ধ্বংস হয়ে গেছে’! ‘এ সময় বলা হবে, ওকে ধর’। ‘অতঃপর ওকে বেড়ীবদ্ধ কর’। ‘অতঃপর ওকে জাহান্নামে নিক্ষেপ কর’। ‘অতঃপর সত্তুর হাত লম্বা শিকল দিয়ে ওকে শক্ত করে বেঁধে ফেল’ (হাক্কাহ ৬৯/২৫-৩২) ।
‘সেদিন তারা বলবে, হায়! যদি আমরা আল্লাহকে মানতাম ও রাসূলকে মানতাম’! ‘তারা আরও বলবে, হে আমাদের প্রতিপালক! আমরা আমাদের নেতাদের ও বড়দের আনুগত্য করতাম। অতঃপর তারাই আমাদের পথভ্রষ্ট করেছিল’। ‘হে আমাদের প্রতিপালক! তাদেরকে তুমি দ্বিগুণ শাস্তি দাও এবং তাদেরকে মহা অভিশাপ দাও’ (আহযাব ৩৩/৬৬-৬৮) । আল্লাহ বলেন, ‘…সেদিন পাপীদের জন্য কোন সুসংবাদ থাকবে না। তারা বলবে, বাঁচাও বাঁচাও’। ‘আর আমরা সেদিন তাদের কৃতকর্মসমূহের দিকে মনোনিবেশ করব। অতঃপর সেগুলিকে বিক্ষিপ্ত ধূলিকণায় পরিণত করব’ (ফুরক্বান ২৫/২২-২৩) । ‘যালেম সেদিন নিজের দু’হাত কামড়ে বলবে, হায়! যদি (দুনিয়াতে) রাসূলের পথ অবলম্বন করতাম’। ‘হায় দুর্ভোগ! যদি আমি অমুককে বন্ধুরূপে গ্রহণ না করতাম’! ‘আমার কাছে উপদেশ (কুরআন) আসার পর সে আমাকে পথভ্রষ্ট করেছিল। বস্ত্ততঃ শয়তান মানুষের জন্য পথভ্রষ্টকারী’। ‘সেদিন রাসূল বলবেন, হে আমার প্রতিপালক! নিশ্চয়ই আমার উম্মত এই কুরআনকে পরিত্যাজ্য গণ্য করেছিল’। ‘এভাবেই আমরা প্রত্যেক নবীর জন্য অপরাধীদের মধ্য থেকে শত্রু করেছি। আর তোমার জন্য পথপ্রদর্শক ও সাহায্যকারী হিসাবে তোমার পালনকর্তাই যথেষ্ট’ (ফুরক্বান ২৫/২৭-৩১) ।
‘(সেদিন) জান্নাতবাসীরা জাহান্নামবাসীদের (উপহাস করে) বলবে, আমাদের প্রতিপালক আমাদের যেসব প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, সবই আমরা যথার্থভাবে পেয়েছি। এখন তোমরা কি তোমাদের প্রতিপালকের দেওয়া প্রতিশ্রুতি যথার্থভাবে পেয়েছ? তারা বলবে, হ্যাঁ। অতঃপর একজন ঘোষক উভয় দলের মধ্যে ঘোষণা করে বলবে, যালিমদের উপর আল্লাহর অভিসম্পাৎ’। ‘তারা আল্লাহর পথ থেকে মানুষকে বাধা দিত এবং তাতে বক্রতা খুঁজে বেড়াত। আর তারা আখেরাতকে অস্বীকার করত’ (আ‘রাফ ৭/৪৪-৪৫) ।
অতঃপর মানব জাতির প্রতি সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর নাযিলকৃত সর্বশেষ আয়াত, ‘আর তোমরা ঐ দিনকে ভয় কর, যেদিন তোমরা সকলে আল্লাহর নিকটে ফিরে যাবে। আর সেদিন প্রত্যেকে স্ব স্ব কর্মের ফল পুরোপুরি পাবে এবং তাদের প্রতি কোনরূপ অবিচার করা হবে না’ (বাক্বারাহ ২/২৮১) । তালাবদ্ধ হৃদয় সমূহে কুরআনের উপরোক্ত বাণীগুলি করাঘাত করবে কি?

দাজ্জালের অবির্ভাব নিয়ে ভ্রান্তি নিরসন

দাজ্জালের অবির্ভাব নিয়ে ভ্রান্তি নিরসন

দাজ্জালের অবির্ভাব নিয়ে ভ্রান্তি নিরসন

                                                        বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম
                                         পরম করুনময় আল্লাহর নাম সরন করি
                                                   সগ্রহকারি মোঃ রোকন সরকার


ভূমিকা : ক্বিয়ামতের আলামত সমূহের অন্যতম হ’ল দাজ্জালের আবির্ভাব। সে ক্বিয়ামতের পূর্বে বের হয়ে আসবে। হাদীছে তার সম্পর্কে সবিস্তার বিবরণ উল্লিখিত হয়েছে। কিন্তু সাম্প্রতিককালে কেউ কেউ দাজ্জালের আবির্ভাবের কথা ফলাও করে প্রচার করছে। আবার তাদের দাবীর পক্ষে কুরআন-হাদীছের দলীলও পেশ করছে। যা সর্বৈব মিথ্যা। এসব মিথ্যা প্রচারের ফলে জনমনে সৃষ্ট ভ্রান্ত ধারণা দূর করতে এবং দাজ্জাল সম্পর্কে সঠিক বিষয় তুলে ধরার জন্যই এই ক্ষুদ্র প্রয়াস।
দাজ্জালের পরিচয় : দাজ্জালের পুরো নাম ‘মাসীহুদ দাজ্জাল’। মাসীহ : এর অর্থ সম্পর্কে হাফেয ইবনে হাজার আসক্বালানী (রহঃ) বলেন, يُقَالُ إِنَّهُ سُمِّيَ بِذَلِكَ لِكَوْنِهِ يَمْسَحُ الْأَرْضَ وَقِيلَ سُمِّيَ بِذَلِكَ لِأَنَّهُ مَمْسُوحُ الْعَيْنِ ‘বলা হয় যে, তাকে এই নামে নামকরণ করা হয়েছে, কারণ সে পৃথিবী ধ্বংস করবে। কারো মতে, যেহেতু তার এক চোখ কানা থাকবে তাই এ নামে তাকে নামকরণ করা হয়েছে’।[1]
দাজ্জালের বৈশিষ্ট্য :
১. দাজ্জাল খুরাসান হ’তে বের হবে।[2] ২. দাজ্জালের সাথে পানি ও আগুন থাকবে। তার আগুন হবে ঠান্ডা পানি এবং তার পানি হবে আগুন।[3] ৩. দাজ্জালের ডান চোখ কানা হবে। যেন তা ফোলা আঙ্গুর।[4] ৪. দাজ্জাল স্থুলকায়, লাল বর্ণের, কোঁকড়ানো চুল বিশিষ্ট হবে।[5] ৫. দাজ্জালের দু’চোখের মাঝখানে কাফির শব্দটি লেখা থাকবে।[6] ৬. দাজ্জাল মক্কা-মদীনাতে প্রবেশ করতে পারবে না।[7] ৭. দাজ্জাল মধ্য বয়স্ক যুবক হবে। সে শাম ও ইরাকের মধ্যবর্তী স্থানে আবির্ভূত হবে।[8] ৮. সে চল্লিশ দিন বা চল্লিশ মাস বা চল্লিশ বছর অবস্থান করবে। এরপর আল্লাহ ঈসা (আঃ)-কে প্রেরণ করবেন। তিনি দাজ্জালকে হত্যা করবেন।[9]
দাজ্জাল সম্পর্কে ভ্রান্ত আক্বীদা ও তা পর্যালোচনা :
অনেকেই দাজ্জালের দেহবিশিষ্ট ‘ব্যক্তি’ হওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করেন। তারা দাজ্জাল বলতে ‘ইহুদী-খৃষ্টান সভ্যতা’কে উদ্দেশ্য করেন। সম্প্রতি মোহাম্মাদ বায়েজীদ খান লিখিত ‘দাজ্জাল? ইহুদী-খৃস্টান সভ্যতা!’ শিরোনামে একটি বই প্রচার করা হচ্ছে। বইটির মূল প্রতিপাদ্য হ’ল- ইহুদী-খৃষ্টান সভ্যতাই দাজ্জাল। সেখানে অনেক ভুল তথ্য উপস্থাপন করা হয়েছে। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য কতিপয় তথ্য বিশ্লেষণ সহ নিম্নে উল্লেখ করা হ’ল।-
(১) ‘৪৭৬ বছর আগেই দাজ্জালের জন্ম হোয়েছে এবং সে তার শৈশব, কৈশোর পার হোয়ে বর্ত্তমানে যৌবনে আছে…’।[10]
জবাব : কোন যঈফ বা জাল হাদীছেও দাজ্জালের বয়স সম্পর্কে বলা হয়নি। দাজ্জালের জন্ম তারিখ বা সন কোন হাদীছে বর্ণিত হয়নি।
(২) ‘মহাশক্তিধর পাশ্চাত্য বস্ত্তবাদী সভ্যতাই হচ্ছে আল্লাহর রাসুল বর্ণিত সেই নির্দিষ্ট দাজ্জাল’।[11]
জবাব : এটি মনগড়া ও কপোলকল্পিত দাবী। কোন নির্দিষ্ট সভ্যতাকে দাজ্জাল বলার দলীল নেই। এমনকি ইহুদী-খৃষ্টান সভ্যতাকে দাজ্জাল আখ্যায়িত করা স্রেফ মিথ্যাচার বৈ কিছুই নয়। কারণ হাদীছে দাজ্জালের দৈহিক বর্ণনা ও অবস্থানকাল বর্ণিত হয়েছে। অথচ হাদীছের বিরোধিতা করে ইহুদী-খৃষ্টান সভ্যতাকে দাজ্জাল বলা হচ্ছে। যার পক্ষে কোন আয়াত কিংবা ছহীহ বা হাসান হাদীছ নেই।
(৩) ‘তেমনি অনেক সত্য হাদীছও সত্য হওয়া সত্ত্বেও এসনাদের অভাবে বাদ পোড়ে গেছে। কোন একটি বিষয়ে পূর্ণ ধারণা করার জন্য প্রয়োজন ঐ বিষয়টি সম্বন্ধে সহিহ, হাসান, দয়ীফ, এমন কি পরিত্যক্ত হাদীছও পর্যালোচনা করে একটি সম্যক ধারণা করা। তাতে ঐ বিষয়টি সম্বন্ধে একটি পূর্ণ চিত্র মনে ফুটে ওঠে। দাজ্জাল সম্বন্ধে আলোচনাতেও আমি এই নীতিই গ্রহণ করেছি, যদিও ভিত্তি অবশ্যই রয়েছে ছহিহ হাদীছগুলির ওপর’।[12]
জবাব : এটি হাস্যকর ও অজ্ঞতাপ্রসুত দাবী। সত্য হাদীছ ইসনাদের (সনদের) অভাবে বাদ পড়ে গেছে মর্মে দাবী করার অর্থ হ’ল আল্লাহ তাঁর দ্বীনকে হেফাযত করতে ব্যর্থ হয়েছেন (নাঊযুবিল্লাহ)। যঈফ, জাল, পরিত্যক্ত হাদীছ দ্বারা কোন বিষয়ের সম্যক ধারণা পেতে হবে, এটিও একটি বাতিল চিন্তাধারা। আমরা জানি যে, নবী করীম (ছাঃ) এবং ছাহাবাদের মধ্যে পরিত্যক্ত, বাতিল হাদীছ ছিল না। তাই বলে কি ছাহাবীগণ ইসলাম সম্পর্কে পূর্ণ ধারণা অর্জন করেননি? তিনি যদিও ছহীহ হাদীছকে ভিত্তি করার দাবী করেছেন। কিন্তু স্বীয় দাবী মোতাবেক একটি ছহীহ হাদীছও পেশ করতে সক্ষম হননি।
(৪) ‘কিন্তু তার সময়ের মানুষের শিক্ষার স্বল্পতার জন্য তাঁকে বাধ্য হোয়ে দাজ্জালকে রূপকভাবে বর্ণনা করতে হয়েছে’।[13]
পর্যালোচনা : (ক) মুহাম্মাদ (ছাঃ) দাজ্জালের বিষয়টি ‘মাজাযী’ বা রূপকভাবে বর্ণনা করেছেন বলে কোন দলীল নেই। (খ) অত্র উক্তি দ্বারা তিনি ছাহাবীদেরকে স্বল্প শিক্ষিত বলে দাবী করেছেন, যা আদবের খেলাফ ও চরম ভ্রান্তিমূলক। কারণ শরী‘আত সম্পর্কে ছাহাবীগণ সর্বাধিক অবহিত ছিলেন।
(৫) ‘কিন্তু সে রূপক বর্ণনা আজ পরিষ্কারভাবে ধরা দিয়েছে, যদিও আমাদের প্রায়ান্ধ দৃষ্টির জন্য সে বর্ণনাও আমরা বুঝতে সক্ষম হোচ্ছি না’…।[14]
পর্যালোচনা : নবীর বাণীর মর্ম এতদিন গোপন ছিল (?)। আজ তার অন্তর্নিহিত মর্ম পরিষ্কার হয়েছে টাঙ্গাইলের একজন সাধারণ শিক্ষিত ব্যক্তির নিকটে (?)।* উক্ত দাবী একেবারেই হাস্যকর ও উদ্ভট দাবী। ঐ উক্তিতে সকল স্তরের মানুষদেরকে ‘প্রায়ান্ধ’ বলে তুচ্ছ করার ধৃষ্টতা প্রদর্শন করেছেন বায়েজীদ খান। যাদের মধ্যে ইমাম, মুহাদ্দিছ, মুফাসসির, ফক্বীহ সবাই শামিল। এটা মূলতঃ লেখকের অপরিপক্ক জ্ঞান ও অনুর্বর মস্তিষ্কের চিন্তা-ধারার ফসল।
(৬) ‘আল্লাহর রসুল একে দাজ্জাল নামে অভিহিত কোরেছেন। কিন্তু এটা কোন নাম নয়, এটা একটা বর্ণনা, অর্থাৎ বিষয়টার বর্ণনা’।[15]
পর্যালোচনা : এটাও অজ্ঞতাসূলভ হাস্যকর দাবী। রাসূল (ছাঃ) দাজ্জাল নামের একজন ব্যক্তির কথা স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন। ‘দাজ্জাল’ কোন বর্ণনা নয়। বরং এটি ব্যক্তির নাম। কোন নাম আর বর্ণনা এক নয়।
‘দাজ্জালের পরিচিতি’ (পৃঃ ২৯) শিরোনামে লেখক কতগুলি হাদীছ এনেছেন। যেমন-
হাদীছ-১ : ‘দাজ্জাল ইহুদী জাতির মধ্যে থেকে উত্থিত হবে এবং ইহুদী ও মুনাফেকরা তার অনুসারী হবে’ (পৃঃ ২৯)
পর্যালোচনা : তিনি এখানে ইহুদী ও মুনাফেক্বের কথা বলে সেটি রাসূল (ছাঃ)-এর প্রতি সম্বন্ধ করেছেন এবং মুসলিমের দলীল প্রদান করেছেন। অথচ ছহীহ মুসলিমে এমন কোন হাদীছ নেই। বরং يَخْرُجُ الدَّجَّالُ فِيْ أُمَّتِيْ ‘আমার উম্মতের মধ্য হ’তে দাজ্জাল বের হবে’ এমনটিই বলা হয়েছে।[16] অন্য হাদীছে এসেছে যে, ‘ইহূদীগণ তার অনুসারী হবে’। কিন্তু ছহীহ মুসলিমের কোথাও ‘দাজ্জাল ইহূদীর মধ্য হ’তে হবে’ বলে কোন হাদীছ নেই। এভাবে তিনি হাদীছ বিকৃত করেছেন ও তথ্যসূত্র ভুল উল্লেখ করেছেন।
হাদীছ-২ : ‘দাজ্জাল নিজেকে মানুষের রব, প্রভু বোলে ঘোষণা কোরবে এবং মানবজাতিকে বোলবে তাকে রব বলে স্বীকার কোরে নিতে’ (পৃঃ ৩০)
পর্যালোচনা : এ হাদীছটি বর্ণনা করার পর তিনি উদ্ভট কিছু ব্যাখ্যা প্রদান করে এটি প্রমাণ করতে চেষ্টা করেছেন যে, পাশ্চাত্যের ইহুদী-খ্রীষ্টানই অত্র হাদীছে উদ্দেশ্য। তিনি কোন হাদীছের নম্বর বা অনুচ্ছেদ, অধ্যায় উল্লেখ করেননি। আরবী ইবারতও লিখেননি। স্রেফ ‘বুখারী’ লিখে দিয়েছেন। ছহীহুল বুখারীর দাজ্জাল বিষয়ক হাদীছগুলিতে অত্র উক্তি সম্বলিত কোন হাদীছ আমরা অবগত হ’তে পারিনি।[17]
হাদীছ-৩ : ‘দাজ্জালের বাহনের দুই কানের দূরত্ব হবে সত্তর হাত’ (পৃঃ ৩১)
পর্যালোচনা : এখানে উদ্ধৃতি হিসাবে বায়হাক্বী ও মিশকাতের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। অত্র হাদীছটির সনদ ও মতন হ’ল-
مُحَمَّدُ بْنُ عُقْبَةَ بْنِ أَبِيْ عَتَّابٍ الْمَدِيْنِيُّ، عَنْ أَبِيهِ، عَنْ أَبِيْ هُرَيْرَةَ، عَنِ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: يَخْرُجُ الدَّجَّالُ عَلَى حِمَارٍ أَقْمَرَ، مَا بَيْنَ أُذُنَيْهِ سَبْعُوْنَ بَاعًا-
‘দাজ্জাল সাদা (সবুজ মিশ্রিত) রং-এর গাধায় চড়ে বের হবে। তার দু’কানের মাঝে সত্তর হাত (প্রসারিত দু’বাহু পরিমাণ) দূরত্ব থাকবে’।[18]
(১) শায়খ আলবানী (রহঃ) একে অত্যন্ত দুর্বল বলেছেন।[19]
(২) শায়েখ যুবায়ের আলী যাঈ বলেছেন, এটা আমি পাইনি। বায়হাক্বী একে ‘আল-বা‘ছু ওয়ান-নুশূর’ গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন (যা আমি পাইনি)। বুখারী একে আত-তারীখুল কাবীর গ্রন্থে (১/১৯৯) বর্ণনা করেছেন। তবে এর সনদ যঈফ।[20]
গ্রহণযোগ্য হাদীছে বলা হয়েছে-
يَخْرُجُ الدَّجَّالُ عَلَى حِمَارٍ، رِجْسٌ عَلَى رِجْسٍ ‘দাজ্জাল একটি অপবিত্র গাধার উপর চড়ে বের হবে। নাপাকির উপর নাপাকি (যার পুরোটাই নাপাকিতে ভরপুর থাকবে)’।[21]
হাদীছ-৪ : ‘দাজ্জালের গতি হবে অতি দ্রুত। সে বায়ু তাড়িত মেঘের মত আকাশ দিয়ে উড়ে চোলবে’ (পৃঃ ৩২)
পর্যালোচনা : তিনি নাওয়াস বিন সাম‘আন (রাঃ)-এর বর্ণনায় মুসলিম ও তিরমিযীর উদ্ধৃতি দিয়েছেন। মুসলিমে এমন কোন হাদীছ নেই। বরং মুসলিমে আছে, قُلْنَا: يَا رَسُولَ اللهِ وَمَا إِسْرَاعُهُ فِي الْأَرْضِ؟ قَالَكَالْغَيْثِ اسْتَدْبَرَتْهُ الرِّيحُ، ‘বাতাসের প্রবাহ মেঘমালাকে যেভাবে হাঁকিয়ে নিয়ে যায় তার গতি হবে তেমন’।[22] অন্য হাদীছে পরিষ্কারভাবে বলা হয়েছে,إِنَّهُ شَابٌّ قَطَطٌ، عَيْنُهُ طَافِئَةٌ، كَأَنِّي أُشَبِّهُهُ بِعَبْدِ الْعُزَّى بْنِ قَطَنٍ ‘সে হবে মধ্যবয়সী যুবক। তার চোখ হবে ফোলা আঙ্গুরের ন্যায়। যেন আমি তার মধ্যে আব্দুল উয্যা বিন ক্বাত্বান-এর সাদৃশ্য পাচ্ছি (ঐ)। এখানে দাজ্জালকে স্পষ্টভাবে মানুষ বলা হ’ল। তাকে মানুষের সাথে সাদৃশ্যও দেয়া হ’ল। এরপরও দাজ্জালকে মানুষ হিসাবে অস্বীকার করার কোন কারণ থাকতে পারে না।
হাদীছ-৫ : ‘আল্লাহর রসুল বোলেছেন- দাজ্জালের আদেশে আকাশ থেকে বৃষ্টি বর্ষণ হবে’ (পৃঃ ৩৩)
তাহক্বীক্ব : এখানেও তিনি উপরোল্লিখিত নাওয়াস বিন সাম‘আনের হাদীছটির উদ্ধৃতি দিয়েছেন। এতে আছে, إِنَّهُ شَابٌّ قَطَطٌ، عَيْنُهُ طَافِئَةٌ[23] এখানে স্পষ্টভবে বলা হয়েছে যে, দাজ্জাল একজন মধ্যবয়স্ক যুবক হবে যে চল্লিশ দিন থাকবে। অথচ এই কথাটিকে গোপন রেখে স্রেফ পানি বর্ষণের বিষয়টি তুলে ধরে তিনি ধোঁকা দিয়েছেন।
হাদীছ-৬ : ‘দাজ্জালের কাছে রেযকের বিশাল ভান্ডার থাকবে। সেখান থেকে সে যাকে ইচ্ছা তাকে দেবে। যারা তার বিরোধিতা কোরবে তাদের সে ঐ ভান্ডার থেকে রেযক দেবে না। এইভাবে সে মোসলিমদের অত্যন্ত কষ্ট দিবে। যারা দাজ্জালকে অনুসরণ কোরবে তারা আরামে থাকবে আর যারা তা কোরবে না তারা কষ্টে থাকবে’(পৃঃ ৩৪)
পর্যালোচনা : এখানে তিনি বুখারী এবং মুসলিমের উদ্ধৃতি প্রদান করেছেন। ছহীহ বুখারীতে এই ভাষার কোন হাদীছ নেই। মুসলিমেও এমন সরাসরি উক্তি নেই যাকে নবীর কথা বলে চালানো যায়।
হাদীছ-৭ : ‘দাজ্জালের ডান চোখ অন্ধ হবে’ (পৃঃ ৩৫)
পর্যালোচনা : তিনি এখানে বুখারী ও মুসলিমের উদ্ধৃতি পেশ করেছেন।
(১) বুখারীতে আছে- নবী করীম (ছাঃ) বলেছেন, ‘এরপর আমি তাকাতে থাকলাম, হঠাৎ দেখতে পেলাম, একজন ব্যক্তি স্থুলকায় লাল বর্ণের, কোঁকড়ানো চুল, এক চোখ অন্ধ, চোখটি যেন ফোলা আঙ্গুরের ন্যায়’।[24] অত্র হাদীছে রাসূল (ছাঃ) ‘রাজুল’ তথা ‘পুরুষ মানুষ’ শব্দটি উল্লেখ করেছেন। অতঃপর স্থুলকায়, লাল বর্ণ ইত্যাদি বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ করেছেন। যা প্রমাণ করে যে দাজ্জাল নিঃসেন্দহে একজন মানুষ। এগুলিকে পরিহার করে নিজের মনগড়া দাবীর পক্ষে একরাশ মিথ্যচারকে প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে লেখক হাদীছের খন্ডিত অংশ উপস্থাপন করে বানোয়াট ব্যাখ্যার অবতারণা করেছেন।
(২) (ক) ছহীহ মুসলিমে আছে, ‘আর আমি একজন পুরুষকে দেখলাম, লালবর্ণ…[25] হাদীছটির ইবারত-
وَرَأَيْتُ وَرَاءَهُ رَجُلًا أَحْمَرَ، جَعْدَ الرَّأْسِ، أَعْوَرَ الْعَيْنِ الْيُمْنَى، أَشْبَهُ مَنْ رَأَيْتُ بِهِ ابْنُ قَطَنٍ، فَسَأَلْتُ مَنْ هَذَا؟ فَقَالُوا الْمَسِيحُ الدَّجَّالُ-
‘আমি তার পিছনে একজন লালবর্ণের, ঘন-কেশের পুরুষ মানুষকে দেখলাম। যার একটি চোখ অন্ধ। আমি যাকে দেখেছি সে ইবনু ক্বাত্বান-এর ন্যায়। আমি জিজ্ঞেস করলাম, এ কে? তারা বলল, মাসীহুদ দাজ্জাল’।[26]
(খ) মুসলিম (রহঃ) লিখেছেন,فَإِذَا رَجُلٌ أَحْمَرُ، جَسِيْمٌ، جَعْدُ الرَّأْسِ، أَعْوَرُالْعَيْنِ، كَأَنَّ عَيْنَهُ عِنَبَةٌ طَافِيَةٌ، قُلْتُ: مَنْ هَذَا؟ قَالُوا: الدَّجَّالُ، ‘হঠাৎ একজন লালবর্ণের, মোটা, ঘন-কেশের পুরুষ মানুষকে দেখলাম। যার একটি চোখ অন্ধ, চোখটি যেন ফোলা আঙ্গুরের ন্যায়। আমি জিজ্ঞেস করলাম, এই ব্যক্তি কে? তারা বলল, মাসীহুদ দাজ্জাল’।[27]
(গ) ইমাম মুসলিম (রহঃ) হাদীছ বর্ণনা করেছেন, الدَّجَّالُ أَعْوَرُ الْعَيْنِ الْيُسْرَى، جُفَالُ الشَّعَرِ، مَعَهُ جَنَّةٌ وَنَارٌ، فَنَارُهُ جَنَّةٌ وَجَنَّتُهُ نَارٌ ‘দাজ্জালের বাম চোখ কানা ও ঘন চুলের অধিকারী হবে। তার সাথে জান্নাত ও জাহান্নাম থাকবে। তার জাহান্নামই হ’ল (প্রকৃত) জান্নাত এবং তার জান্নাত হ’ল (প্রকৃত) জাহান্নাম’।[28]
বুখারী ও মুসলিমের উপরোল্লিখিত চারটি হাদীছের মধ্যে দাজ্জালকে মানুষ বলে অভিহিত করা হয়েছে। এরপরও একে অস্বীকার করে ‘ইহুদী-খ্রীষ্টান সভ্যতা’কে দাজ্জাল বলা অন্যায় ও জঘন্য মিথ্যাচার।
হাদীছ-৮ : ‘আমার উম্মতের সত্তর হাজার লোক দাজ্জালের অনুসরণ কোরবে’ (পৃঃ ৪৬)
পর্যালোচনা : তিনি দলীল হিসাবে ‘শারহুস সুন্নাহ’র উদ্ধৃতি পেশ করেছেন। হাদীছটি হ’ল-
عَنْ أَبِي سَعِيدٍ الْخُدْرِيِّ، قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: يَتْبَعُ الدَّجَّالَ مِنْ أُمَّتِي سَبْعُونَ أَلْفًا عَلَيْهِمُ السِّيجَانُ-
আবূ সাঈদ খুদরী বলেছেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘আমার উম্মতের মধ্য হ’তে সত্তর হাযার লোক দাজ্জালকে অনুরণ করবে’।[29]
তাহক্বীক্ব : এ হাদীছটি অত্যন্ত যঈফ।
(১) শায়েখ আলবানী (রহঃ) এটিকে যঈফ বলেছেন।[30] তিনি বলেন, ضعيف جداً بلفظ أمتي ‘আমার উম্মত’ শব্দ যোগে (এটি) অত্যন্ত দুর্বল। তিনি আরো বলেছেন, قلت: وهذا إسناد ضعيف جداً؛ أبو هارون اسمه: عمارة بن جُوَين، قال الحافظ في التقريب متروك، ومنهم من كذبه ‘আমি বলেছি, সনদটি খুবই যঈফ। আবূ হারূণের নাম হ’ল উমারাহ বিন জুয়াইন। হাফেয ইবনে হাজার ‘আত-তাক্বরীব’ গ্রন্থে বলেছেন, তিনি মাতরূক। তিনি মিথ্যুকদের অন্যতম।[31]
(২) শায়েখ যুবায়ের আলী যাঈ (রহঃ) বলেছেন, ‘এর সনদ খুবই দুর্বল। বাগাবী এটি শারহুস সুন্নাহ (হা/৪২৬৫, ১৫/১২) গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন। এতে ‘আবূ হারূন আল-আবদী’ নামক মাতরূক রাবী রয়েছেন। যিনি মিথ্যার দোষে অভিযুক্ত। আর মুসলিমের হাদীছটি (হা/২৯৪৪)-এর বিরোধী’।[32]
(৩) মোল্লা আলী ক্বারী হানাফী (রহঃ) বলেছেন, قِيلَ: فِي سَنَدِهِ أَبُو هَارُونَ وَهُوَ مَتْرُوكٌ ‘বলা হয়েছে, এর সনদের মধ্যে আবূ হারূণ রয়েছেন। আর তিনি মাতরূক’।[33] এটি ছহীহ মুসলিমের হাদীছের সরাসরি বিরোধী- আনাস বিন মালেক (রাঃ) বলেছেন,أَنَّ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: يَتْبَعُ الدَّجَّالَ مِنْ يَهُودِ أَصْبَهَانَ، سَبْعُونَ أَلْفًا عَلَيْهِمُ الطَّيَالِسَةُ ‘ইস্পাহানের সত্তর হাযার ইহুদী দাজ্জালের অনুসরণ করবে। যাদের পরনে ত্বায়ালিসাহ (এক ধরনের পোষাক) থাকবে।[34] অতএব সত্তর হাযার উম্মত তাকে অনুসরণ করবে- এটি ভ্রান্ত দাবী।
হাদীছ-৯ : ‘দাজ্জালের শক্তি, প্রভাব ও প্রতিপত্তি পৃথিবীর সমস্ত মাটি ও পানি (ভূ-ভাগ ও সমুদ্র) আচ্ছন্ন কোরবে। সমস্ত পৃথিবীর পৃষ্ঠদেশ চামড়া দিয়ে জড়ানো একটি বস্ত্তর মত তার করায়ত্ত হবে’ (পৃঃ ৪৮)
পর্যালোচনা : এমন কোন হাদীছ আমরা খুঁজে পাইনি। তবে একটি হাদীছ এর কাছাকাছি-وَإِنَّهُ سَيَظْهَرُ عَلَى الْأَرْضِ كُلِّهَا إِلاَّ الْحَرَمَ، وَبَيْتَ الْمَقْدِسِ ‘আর অচিরেই দাজ্জাল হারাম ও বায়তুল মাক্বদেস ব্যতীত সমগ্র যমীনকে জয় করবে’।[35] যা হাদীছে নেই তাকে রাসূলের প্রতি সম্বন্ধ করা হারাম। এটি জঘন্যতম মিথ্যাচার।
(১) আবূ সাঈদ খুদরী (রাঃ) বর্ণিত হাদীছে রয়েছে, يَخْرُجُ الدَّجَّالُ فَيَتَوَجَّهُ قِبَلَهُ رَجُلٌ مِنَ الْمُؤْمِنِينَ ‘দাজ্জাল বের হবে এবং সে একজন মুমিন ব্যক্তির প্রতি মনোনিবেশ করবে’।[36] দাজ্জাল সেই লোকটিকে হত্যাও করবে। লেখকের দাবী মোতাবেক দাজ্জালের আবির্ভাবের ৪৭৬ বছর হয়ে গিয়েছে (পৃঃ ১)। তাহ’লে দাজ্জাল এই লোকটিকে এখনো হত্যা করল না কেন?
(২) বুখারীর অসংখ্য স্থানে ‘মাসীহুদ দাজ্জাল’ শব্দটি এসছে। তন্মধ্যে একটি হাদীছে এসেছে- وَإِذَا أَنَا بِرَجُلٍ جَعْدٍ قَطَطٍ، أَعْوَرِ العَيْنِ اليُمْنَى كَأَنَّهَا عِنَبَةٌ طَافِيَةٌ ‘আর একজন মধ্য বয়স্ক পুরুষ মানুষকে দেখলাম যার বাম চোখ কানা যেন তা ফোলা আঙ্গুরের ন্যায়’।[37] অত্র হাদীছে স্পষ্টভাবে ‘মাসীহুদ দাজ্জাল’কে পুরুষ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে।
(৩) মুসলিমের অসংখ্য স্থানেই ‘মাসীহুদ দাজ্জাল’ শব্দটি এসেছে। তবে বুখারীর উপরোক্ত হাদীছটি (হা/৫৯০২)ছহীহ মুসলিমেও আছে।[38]
(৪) আবূদাঊদের একাধিক স্থানে ‘মাসীহুদ দাজ্জাল’ শব্দটি এসেছে। একটি হাদীছে এসেছে, إِنَّ مَسِيْحَ الدَّجَّالِ رَجُلٌ قَصِيْرٌ ‘নিশ্চয়ই মাসীহ দাজ্জাল একজন খাটো মানুষ (হা/৪৩২০)। লেখকের উদ্ধৃত উবাদাহ বিন ছামেত বর্ণিত এই হাদীছেও একেবারেই স্পষ্ট ভাষায় দাজ্জালকে ‘একজন খাটো মানুষ’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
উপসংহার : দাজ্জালের বিষয়ে মুসলমানদেরকে ফিৎনায় ফেলা কিছু মানুষের উদ্দেশ্য ছিল। ফলে তারা এ বিষয়ে মিথ্যা প্রচারণা আরম্ভ করে। সাথে সাথে হাদীছের অপব্যাখ্যা করে মানুষকে বিভ্রান্ত করতে অপপ্রয়াস চালায়। তাই তাদের খপ্পর থেকে বেঁচে থাকার জন্য মুসলমানদেরকে সর্বাত্মক চেষ্টা করতে হবে। আল্লাহ আমাদের সহায় হৌন।-আমীন

সুরা: ইয়াসিন আরবি & বাংলা উচ্চারণ

সুরা: ইয়াসিন بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَٰنِ الرَّحِيمِ আরবি & বাংলা উচ্চারণ বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম (পরম করুণাময় অতি দয়ালু আল...