Friday, February 21, 2020

শয়তানের ফাঁদ

প্রবন্ধটি পড়া হলে, শেয়ার করতে ভুলবেন না
রহমান রহীম আল্লাহ্‌ তায়ালার নামে-
 সগ্রহকারি মোঃ রোকন সরকার

এখানে শয়তান কিভাবে মানুষকে বিপথে চালিত করে তা বর্ণিত হলো:

শয়তান বিভিন্ন পন্থায় তার কাজ চালিয়ে যায়। এমনকি অনেক মুসলিম শয়তানের মিত্র হিসেবে কাজ করছে অথচ তারা এ বিষয়ে সচেতন নয়। শয়তান এক গভীর ষড়যন্ত্রকারী। সকল খারাপ কাজই শয়তানের কুমন্ত্রণার ফসল। শয়তানের এসব খারাপ কাজ সম্পর্কে আল্লাহ্‌ ঠিকই অবহিত আছেন। তাই আল্লাহ্‌ ও মুমিনদের কাছে এসব ষড়যন্ত্র খুবই দুর্বল: তোমরা জিহাদ করতে থাক শয়তানের পক্ষালম্বনকারীদের বিরুদ্ধে, (দেখবে) শয়তানের চক্রান্ত একান্তই দুর্বল।” [নিসা : ৭৬]

১. অনর্থক মতানৈক্য ও সন্দেহের উদ্রেক করার মাধ্যমে:

রাসুল (সঃ) বলেন “বস্তুতপক্ষে শয়তান প্রকৃত মুমিনদেরকে তার পথে পরিচালিত করতে ব্যর্থ হবে… কিন্তু শয়তান তাদের মধ্যে মতানৈক্য ও বিরোধ সৃষ্টির পাঁয়তারা করবে।” [মুসলিম শরীফ] অর্থাৎ শয়তান মুমিনদের মধ্যে পরস্পরের প্রতি ঘৃণা সৃষ্টির চেষ্টা করবে এবং তাদেরকে একে অন্যের বিরুদ্ধে লাগিয়ে দেবে যাতে তারা আল্লাহ্‌র স্মরণ হতে বিরত থাকে। এমনকি আমাদের মনে যে খারাপ চিন্তা ও সন্দেহের উদ্রেক হয় তা শয়তানেরই কাজ। রাসূল (সঃ) এর স্ত্রী সাফিয়্যা (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত,
রাসূল (সঃ) একবার ইতিকাফের সময় মসজিদে অবস্থান করছিলেন। আমি রাত্রিবেলা তাঁর সাথে দেখা করতে এসেছিলাম। কথা শেষ হলে আমি যখন বাড়ি ফিরব তখন রাসূল (সঃ) আমাকে এগিয়ে দেবার জন্য সঙ্গে আসলেন। পথিমধ্যে দুজন আনসার আমাদের অতিক্রম করে গেল এবং রাসূল (সঃ) কে দেখার সাথে সাথে তারা দ্রুত চলতে লাগল। রাসূল (সঃ) তাদের ডেকে বললেন, ‘এদিকে এসো। আমার সাথে সাফিয়্যা বিনতে হুয়াই রয়েছেন।’ তখন তারা বলে উঠলেন: ‘হে রাসূলুল্লাহ্‌ (সঃ), আল্লাহ্‌ সকল সীমাবদ্ধতা হতে কতই না মুক্ত।’ তখন রাসূল (সঃ) বললেন ‘রক্ত যেমনভাবে শিরার মধ্য দিয়ে প্রবাহমান ঠিক তেমনিভাবে শয়তান মানুষের মাঝে প্রবাহমান। এবং আমার ভয় হল যে শয়তান হয়ত তোমাদের অন্তে্রে কোন কুমন্ত্রণা দেবে, ফলে এ নিয়ে বিভিন্ন কথা উঠবে।” [বুখারী]
তাই এটা বাধ্যতামূলক যে, আমার সম্বন্ধে কোন ব্যক্তির যদি কোন ভ্রান্ত ধারণা থাকে তবে তা ভাঙ্গিয়ে দেয়া। শয়তানই মানুষের মধ্যে ভ্রান্ত ধারণার, অমূলক চিন্তা-ভাবনার সৃষ্টি করে। সে মানুষকে অন্যের খারাপ চিন্তা , ধারণাসমূহ শুনতে উৎসাহ দেয় এবং তদনুযায়ী মনে খারাপ ধারণার সৃষ্টি করে। এমনকি প্রার্থনার সময় পর্যন্ত শয়তান মানুষকে রেহাই দেয় না। ঠিক মত ওযু করা হয়েছে কিনা, ঠিকমত সূরা পড়া হয়েছে কিনা ইত্যাদি ধারণা মনের মধ্যে সৃষ্টি করে ইবাদতে বিঘ্ন ঘটায়। তাই অনেকে ইবাদতের সময় কিছুটা অস্বস্তিতে ভোগে।

২. বিদাতকে উৎসাহিত করা:

শয়তান এই বলে মানুষকে বিদাতে প্ররোচিত করে: “এখনকার মানুষ দ্বীন হতে অনেক দূরে সরে গেছে এবং দ্বীনমুখী জীবনব্যবস্থাও তাদের কাছে কঠিন মনে হয়। তাই আমরা ধর্মে এমন নতুন কিছু কেন সংযোজন করছি না যার দ্বারা মানুষ আবার দ্বীনমুখী হয়।” শয়তান মানুষকে আরও বলে: “আমরা কেন নতুন হাদীস তৈরি করছি না যার দ্বারা মানুষের অন্তেরে ভয় সৃষ্টি হয় এবং ধর্মমুখী জীবনব্যবস্থার প্রতি আগ্রহের সৃষ্টি হয়।” এর ফলে তারা নতুন নতুন হাদীস তৈরি করে এবং বলে যে: “আমরা রাসূল (সঃ) এর বিপক্ষে মিথ্যা বলছি না, বরং আমরা তাঁর পক্ষে মিথ্যা বলছি।” তাই তারা নিজেদের মনগড়া কথা মতো জাহান্নাম ও জান্নাতের বর্ণনা দেয় এবং মনে করে এর দ্বারা তারা ভাল কাজ করছে। সুফিয়ান আস সাওরী (রঃ) বলেন: “শয়তান পাপ অপেক্ষা বিদাত অধিক পছন্দ করে। কারণ পাপ কাজ করলে অনুতপ্ত হবার সুযোগ থাকে। কিন্তু বিদাতে তা থাকে না। কারণ সে এটাকে ভাল কাজ বলে মনে করছে।”
বিদাত হলো শয়তানের এক মোক্ষম অস্ত্র যার দ্বারা সে আমাদের দৈনন্দিন কার্যকলাপ ও বিশ্বাসের ওপর গভীর প্রভাব ফেলে। বিদাত পাপ কাজ হতেও ভয়ানক। কারণ এর দ্বারা পুরো ধর্মব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ে এবং মুসলিমদের ঐক্য নষ্ট হয়। সাধারণত পাপ কাজের প্রভাব ব্যক্তির উপর পড়ে, ধর্মের ওপর পড়ে না। কিন্তু বিদাতের মাধ্যমে শয়তান মুসলিম অধ্যুষিত এলাকায় বিভাজন সৃষ্টি করছে যাদের প্রত্যেকেরই রয়েছে বিদাত পালনের বিভিন্ন মতভেদপূর্ণ ব্যবস্থা।
বিদাতের মাধ্যমে শয়তান মুসলিমদের মধ্যে পারস্পরিক শত্রুতা ও বিভাজন সৃষ্টি করছে। শয়তান মানুষের কাছে সুন্নাহকে অপর্যাপ্ত বলে তুলে ধরে। মানুষকে সুন্নাহ্‌র ওপর চলতে ও ধৈর্য্য রাখতে বাধা দেয়। তাই মানুষ বিদাতের সূচনা করে যা মহানবী (সঃ) ও সাহাবীরা কখনোই করতে বলেননি বা করেননি। এই বিদাত অবলম্বনকারী ও অমান্যকারীদের মধ্যে বিরোধ সৃষ্টি হয়। বিদাত অনুসরণই হয়ে ওঠে মানুষকে পছন্দ-অপছন্দের ভিত্তি। তাই এই ভয়াবহ পরিস্থিতি হতে মুক্তির জন্য আমাদের জীবনের সকলক্ষেত্রে সুন্নাহ অনুসরণ করতে হবে। আল ইরবাদ ইবনে সারীয়া (রাঃ) হতে বর্ণিত: “রাসূল (সঃ) আমাদের সামনে এমন কিছু আলোচনা করলেন যার দ্বারা আমাদের অনর্ত ভয়ে পূর্ণ হয়ে গেল এবং আমাদের চোখ বেয়ে পানি পড়তে লাগল। তখন আমরা বললাম ‘এটা আমাদের কাছে আপনার বিদায়ী ভাষণের ন্যায় মনে হচ্ছে। আমাদের কিছু উপদেশ দিন।’ তখন রাসূল (সঃ) বললেন: ‘আমি তোমাদের আল্লাহ্‌কে ভয় করতে নির্দেশ দিচ্ছি আর কোন দাসও যদি তোমাদের নেতা হয় তবুও তাকে তোমরা মান্য করবে। তোমাদের মধ্যে যারা দীর্ঘজীবী হবে তারা অনেক বিরোধপূর্ণ ব্যাপার দেখতে পাবে। তাই তোমরা আমার সুন্নাহ অক্ষত রাখবে এবং সঠিক পথে পরিচালিত খলীফাদের নির্দেশমত চলবে। বিদাত সম্পর্কে সাবধান! (দ্বীনের অংশ হিসেবে) সকল নবউদ্ভাবিত বিষয়ই বিদাত। আর সকল বিদাতই পথভ্রষ্টতা, আর সকল পথভ্রষ্টতার পরিণামই জাহান্নামের আগুন।
বিদাত এই মুসলিম উম্মাহ্‌-এর জন্য একটি ধ্বংসাত্মক ব্যাপার। তাই একজন প্রকৃত মুমিন হিসেবে ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক জীবন থেকে বিদাত সমূলে উৎপাটন করতে হবে। এই বিদাত কোন ইবাদত কিংবা বিশ্বাসের ক্ষেত্রেই হোক বা কোন ধারণাতেই হোক যেটাই সুন্নাহর পরিপন্থী তাই ত্যাগ করতে হবে।

৩. শুধু একটি বিষয়কে সমগ্র দ্বীনের উপর প্রাধান্য দেয়া:

এটি ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত উভয়ক্ষেত্রেই হতে পারে। ব্যক্তিগত ক্ষেত্রে যেসব ঘটনা ঘটে তার কয়েকটি উদাহরণ নিম্নে দেয়া হলো।
  • ক. অনেক ব্যক্তি বিভিন্ন পাপকাজে লিপ্ত থাকে আবার ঠিকমত সালাত আদায় করে। অনেকে মনে করে যেহেতু শেষ বিচারের দিনে সালাতের জন্য প্রথমে হিসাব নেয়া হবে, তাই সালাত ঠিক মত আদায় করলে সাথে সাথে পাপ কাজ করলেও সমস্যা নাই। আবার অনেকে সালাতকে এমন উচ্চস্তেরের ইবাদত মনে করে যে, সে ধারণা করে যে এর দ্বারা সকল পাপকর্ম মাফ হয়ে যাবে। এসবই ভ্রান্ত ধারণা। সালাত অবশ্যই ইসলামের একটি মূলস্তম্ভ, কিন্তু কেবল সালাতই পূর্ণাঙ্গ ইসলাম নয়।তাই আমাদের মনে রাখতে হবে যে সালাত মানুষকে খারাপ কাজ হতে বিরত রাখে এবং তাকে পবিত্র করে। কিন্তু সালাত কোনক্রমেই খারাপ কাজে লিপ্ত হবার অনুমতি দেয় না। এবং এ কথা মনে করে নিশ্চিত হওয়ার কোন উপায় নেই যে সালাতই সকল পাপ কাজের গুনাহ হ্রাস করবে। এসব ভ্রান্ত ধারণা শয়তানেরই প্ররোচনা।বরং প্রকৃত সত্য হচ্ছে সঠিক পদ্ধতিতে ও যথাযথ উপলব্দি সহকারে যিনি বিনয়াবনত হবেন তিনি আল্লাহ নিষিদ্ধ করেছেন এমন সব কাজের নিকটবর্তী হতে লজ্জা পাবেন ও ভয় করবেন এবং সকল কাজে আল্লাহর প্রতি জবাবদিহিতার ব্যাপারে সবসময় সচেতন থাকবেন।
  • খ. উপরে যা উল্লেখ করা হলো তার ঠিক বিপরীত আরেকটি শয়তানের প্ররোচনাজনিত বিভ্রান্তি হলো এই যে কেউ বা দাবী করে থাকে ধর্ম মানেই হলো মানুষের পারস্পরিক সম্পর্ক ও লেনদেনের ব্যাপারে দিক-নির্দেশনা। তাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো মানুষের সাথে ভাল ব্যবহার করা, মিথ্যা না বলা এবং কারো হক নষ্ট না করা। তারা এই ধারণায় এতটাই মগ্ন যে তারা ইবাদত হতে দূরেই থাকে কারণ মহানবী (সঃ) বলেছেন: “দ্বীন মানুষের সাথে লেনদেন বৈ নয়।”অতএব এখানে অন্যান্য ইবাদতের স্থান কোথায়।এটা বলার অপেক্ষা রাখেনা যে লেনদেন ও আচরণের ক্ষেত্রে আল্লাহর আদেশ নিষেধসমূহের প্রতি সতর্কতার সাথে অনুগত থাকা আবশ্যাক। কিন্তু এর দ্বারা কারো পক্ষে (শয়তানের প্ররোচনায়) নিজের মনগড়া ধারনা থেকে আল্লাহর অন্য আদেশসমূহকে গুরুত্বহীন গন্য করার কোন উপায় নেই। অথচ আল্লাহ যেসব বিষয়/ইবাদত বাধ্যতামূলক করে দিয়েছেন তা সর্বাত্নকভাবে পালন করার চেষ্টা করা সকলের জন্যই অপরিহার্য। কোন বাধ্যতামূলক বা ঐচ্ছিক ইবাদাতের তাৎপর্য কেউ বুঝতে না পারলেও তার জন্য জরুরী হচ্ছে তা পালন করতে থাকা আর বিনম্রভাবে দ্বীনের যথাযথ ঞ্জান অর্জনের চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া, আশা করা যায় আল্লাহ তাকে নিজ অনুগ্রহে উপলব্ধি দান করবেন।
  • গ. অনেকে মনে করে ভাল চিন্তা বা ভাল উদ্দেশ্যই আসল। তাই অন্তর পবিত্র রাখতে হবে। এই ধরনের লোকেরা তাই আল্লাহ্‌র ইবাদত ও সৎকর্ম থেকেও দূরে থাকে।শয়তান যাদেরকে এই বিভ্রান্তিতে নিপতিত করেছে তারা এটা বুঝতে অক্ষম যে আল্লাহর আনুগত্যের ব্যাপারে অজ্ঞতা, এর প্রতি উদাসীনতা ও একে গুরুত্বহীন গন্য করার মধ্য দিয়ে তারা নিজেদের অন্তরকে এরমধ্যেই চুড়ান্তভাবে দূষিত করেছে। প্রকৃত সত্য হচ্ছে আল্লাহর প্রতি বিনম্র অনুভুতি, তার আনুগত্যের ব্যাপারে সঠিক জ্ঞান ও তদনুযায়ী অনুসরণের মাধ্যমেই শুধুমাত্র অন্তর বিশুদ্ধতা অর্জন করে, অন্য কোনভাবে নইয়। তাই আমাদের মনে রাখতে হবে অন্তরের প্রকৃত বিশুদ্ধতা কখনোই আল্লাহর ইবাদত, আনুগত্য তথা সৎকর্ম হতে দূরে রাখে না বরং নিকটবর্তি করে। অতএব বিশুদ্ধ অন্তর নিয়েই আমরা সৎকর্ম তথা আল্লাহর ইবাদাত/আনুগত্য করব।
  • ঘ. মুসলিম সমাজে একটি ভ্রান্তধারণা এই যে কোরআনে হাফেয হওয়া বা সুন্দর উচ্চারণে কোরআন শরীফ পড়তে পারাটাই সব এবং এটাই আল্লাহ্‌র রাস্তায় চলার জন্য যথেষ্ট। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে আমাদের উচিত কোরআন শরীফ বুঝে পড়া এবং এর শিক্ষা বাস্তব জীবনে প্রয়োগ করা। উপরোক্ত বিষয়গুলিকে মানুষ সাধারণত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করে এবং ইবাদত ও অন্যান্য ভাল কাজ হতে দূরে থাকে।
  •  যেসব ফাঁদ পেতে শয়তান বেশ সহজেই অনেক মুসলিমকেই প্রবঞ্চিত করে তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে সংখ্যাগরিষ্ঠতার যুক্তি, পূর্বপুরুষদের ঐতিহ্যের দোহাই আর অন্ধ আনুগত্যর অজুহাত। দুনিয়ার এত লোক কি ভুল করছে, আমার বাপদাদা চৌদ্দপুরুষের রীতিনীতি ও ঐতিহ্য কিভাবে আমি অস্বীকার করব, আমার গুরু/পীর/উস্তাদ/দল কিভাবে ভুল করতে পারেন – ইত্যাদি কুযুক্তি যুগে যুগে শয়তান বিভ্রান্ত মানুষের সামনে সত্য প্রত্যাখানের চমৎকার অজুহাত হিসেবে উপস্থাপন করেছে।
    আল্লাহ বলেনঃ“যদি আপনি এই পৃথিবীর সংখ্যাগরিষ্ঠ লোকের অনুসরণ করেন, তাহলে তারা আপনাকে আল্লাহর পথ থেকে বিভ্রান্ত করে দেবে।” [সুরা আল-আনআম ৬:১১৬] “আর যখন তাদেরকে বলা হয় যে, সে হুকুমের আনুগত্য কর যা আল্লাহ নাযিল করেছেন, তখন তারা বলেঃ কখনো না, আমরা ত সে বিষয়েরই অনুসরণ করব, যাতে আমরা আমাদের বাপ-দাদাদেরকে দেখেছি। যদিও তাদের বাপ-দাদারা কিছুই জানত না, আর সরল সঠিক পথেও ছিলনা। বস্তুতঃ এসব সত্য প্রত্যাখ্যানকারীদের উদাহারণ এমন, যেন কেউ এমন জীবকে আহবান করছে, যা কিছুই শোনে না, হাঁক-ডাক আর চিৎকার ছাড়া। এরা বধির, মুক এবং অন্ধ। সুতারাং এরা কিছুই বোঝে না” [সুরা আল-বাকারা ২১:৭০-১৭১, আরো দেখুন ৩৭:৬৯-৭০; ৩১:২১] একবার রাসূলুল্লাহর সাহাবী আদি ইবন হাতিম (রাঃ), যিনি খ্রীষ্ট ধর্ম ছেড়ে ইসলামে ধর্মান্তরিত হন, আল্লাহর রাসূল (সাঃ) কে নিম্নোক্ত আয়াতটি পাঠ করতে শুনলেনঃ“তারা তাদের পণ্ডিত এবং সন্ন্যাসীদেরকে আল্লাহর পাশাপাশি তাদের রব হিসেবে গ্রহণ করেছে।” [সূরা আত তাওবাহ ৯:৩১] শুনে তিনি মন্তব্য করলেন “নিশ্চয়ই আমরা তাদের ইবাদাত করতাম না।” আল্লাহর রাসুল (সাঃ) তাঁর দিকে ফিরে প্রশ্ন করলেনঃ “এমনকি হতো না যে আল্লাহ যা হালাল করেছেন, তারা তা হারাম করে দিত, এবং তোমরাও সেগুলোকে হালাল করে নিতে?”, তিনি জবাবে বললেনঃ “হাঁ, আমরা নিশ্চয়ই তাই করতান।” আল্লাহর রাসূল (সাঃ) বললেনঃ “ওভাবেই তাদের ইবাদাত তোমরা করতে।”(তিরমিজি) মুসলিম মাত্রেরই স্মরণ রাখা উচিৎঃআল্লাহ ও তাঁর রাসূল কোন কাজের আদেশ করলে কোন ঈমানদার পুরূষ ও ঈমানদার নারীর সে বিষয়ে ভিন্ন ক্ষমতা নেই যে, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আদেশ অমান্য করে সে প্রকাশ্য পথভ্রষ্টতায় পতিত হইয়।” [সূরা আলা আহযাব, ৩৩:৩৬]

সামাজিক ক্ষেত্রে যেসব ঘটনা ঘটে তার কয়েকটি নিম্নে বর্ণিত হলো:

ক. দ্বীনের প্রতি দাওয়াতের ব্যাপারে কিছু লোক বিশ্বাস করেন দাওয়াতের ব্যাপারে সময় ও শ্রম ব্যয় করাই একমাত্র গুরুত্বপূর্ণ বিবেচ্য বিষয়। দুর্ভাগ্যজনকভাবে তারা দ্বীনের প্রতি আহবানের ব্যাপারে শরীয়ায় যে স্পষ্ঠ মূলনীতি (principles, methodology) ও অগ্রাধিকারের রুপরেখা (priorities) প্রণীত আছে তার ব্যাপারে উদাসীন থাকেন। সাধারণত, তারা বিনাবাক্যব্যয়ে নেতৃস্থানীয়দের আনুগত্য করে থাকেন। তারা পবিত্র কুরআন, রাসুল (সাঃ) এর সহীহ হাদীসসমূহের প্রমাণাদি ও এর ভিত্তিতে সলফে সালেহীনগ্ণ যে জ্ঞান, প্রজ্ঞা ও বিশ্লষন রেখে গিয়েছেন তার ব্যাপারে উদাসীন ও অজ্ঞাত থাকতে পছন্দ করেন। ফলে তারা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কুরআন ও সুন্নাহর স্পষ্ট নির্দশেনার পরিবর্তে মনগড়া ধ্যান-ধারনা ও চিন্তা ভাবনা দ্বারা পরিচালিত হন। যথেষ্ট আন্তরিকতা নিয়েই দুর্বল ও বানোয়াট হাদীস আর এম্ন অনেক গল্পকাহিনী দিয়ে মানুষকে নিজেদের দিকে আকৃষ্ট করার চেষ্টা করে যান যেগুলো অনেক ক্ষেত্রেই বিভ্রান্ত আকীদার শিক্ষা দেয়। অবস্থাদৃষ্টে মনে হ্য় তারা সচেতন নন যে আল্লাহ ও তার রাসূলের (সাঃ) নামে বানিয়ে কিছু বলা জঘন্যতম অপরাধ, উদ্দেশ্য যেমনি হোকনা কেন।
আল্লাহ বলেনঃ (ভাবার্থঃ) ” … …. … বলুনঃ আমার প্রতিপালক নিষিদ্ধ করেছেন প্রকাশ্য ও অপ্রাকাশ্য অশ্লীলতা, পাপ কাজ, অন্যায় ও অসংগত বিদ্রোহ ও বিরোধিতা এবং আল্লাহর সাথে কোন কিছু শরীক করা যার পক্ষে আল্লাহ কোন প্রমাণ অবতীর্ণ করেন্নি,আর আল্লাহ সম্বন্ধে এমন কিছু বলা যে বিষয়ে তোমাদের কোন জ্ঞান নেই” [সূরা আলা আরাফ ৭:৩৩। এখানে আল্লাহর অপছন্দনীয় কাজগুলোর ধারাবাহিকতার উর্ধক্রমে বলে, এটাকে সবশেষে উল্লেখ করা হয়েছে।] “… … বলুনঃ তোমাদের কাছে কি কোন নিশ্চিত জ্ঞান আছে যা তোমরা প্রমাণ হিসেবে উপস্থিত করতে পার? তোমরা শুধুমাত্র আন্দাজের অনুসরন কর এবং তোমরা শুধু অনুমান করে কথা বল। বলুন, অতএব চুডান্ত প্রমাণ আল্লাহরই … … ।” [সূরা আনআম ৬:১৪৮,১৪৯)[আরো দেখুন – ২:৮০,১৬৯, ৪:১৫৭, ৬:২১,৯৩,১১৬,১৪৪, ৭:২৮,৩৭,৬২, ১০:১৭,৩৬,৬৮,৬৯, ১১:১৮,১৮:১৫,২৩:৩৮, ২৯:৬৮, ৪২:২৪, ৫৩:২৮,৩২, ৬১:৭]
রাসূল (সাঃ) বলেছেনঃ আমি যা বলিনি সে কথা যে আমার নামে বলবে তার আবাসস্থল হবে জাহান্নাম। (বুখারীঃ সালামাহ ইবন আকওয়া বর্ণিত। একই/কাছাকাছি অর্থবোধক হাদীস ১০০ এর বেশী সংখ্যক সহীহ সনদে বর্ণিত হয়েছে, যা এ ব্যাপারে সর্বোচ্চ।) একশ্রেণীর লোক মনে করেন যে, বর্তমানের মুসলিম ও কাফেরদের সামগ্রিক অবস্থান সম্পর্কে জানাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ। স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে রাজনৈতিক সম্পর্কই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। আমরা সেই আগের আমলে নেই। তাই এই উম্মাহ্‌র প্রকৃত মঙ্গলের ক্ষেত্রে ইবাদত ও ঈমান তেমন কার্যকরী নয়। এই শ্রেণীর লোকেরা কমিউনিজম, ধর্মনিরপেক্ষতা, ফ্রিমেসন ইত্যাদি সম্পর্কে বিশদ জ্ঞান রাখেন। সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক ধ্যানধারনা, মতবাদ ও সংশ্লিষ্ট গোষ্ঠীগুলোর ব্যাপারে দ্বীনের জ্ঞানসম্পন্ন মুসলিমদের মধ্যে কয়েকজন বিশেষজ্ঞ থাকতে পারেন যারা প্রয়োজনে এ বিষয়ে অবগত/সতর্ক করবেন। সাধারনভাবে সকল মুসলিমের এসব বিষয়ে জানা জরুরী নয়। সকল মুসলিমের জন্য যা জানা একান্তভাবে জরুরী তা হচ্ছে তাওহীদ ও ঈমানের বুনিয়াদি বিষয়াবলীর জ্ঞান, যা বস্তুতঃ দ্বীনের ভিত্তি – কেবল তাত্ত্বিক/একাডেমিক জ্ঞান নয় বরং প্রয়োজন সঠিক অনুধাবন ও কার্যত বিশ্বাস।

পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহার



প্রবন্ধটি পড়া হলে, শেয়ার করতে ভুলবেন না
রহমান রহীম আল্লাহ্‌ তায়ালার নামে-
সগ্রহকারি মোঃ রোকন সরকার
দীর্ঘ দিন সীমাহীন কষ্ট ও অবর্ণনীয় যাতনা সহ্য করে মা সন্তানকে গর্ভে ধারণ করেন। মায়ের পেটে সন্তান যতই বৃদ্ধি পেতে থাকে তার কষ্টের মাত্রা ততই বাড়তে থাকে। মৃত্যু যন্ত্রনা পার হয়ে যখন সন্তান ভূমিষ্ট হয় তখন এ নবজাতককে ঘিরে মায়ের সব প্রত্যশা এবং স্বপ্ন ঘুরপাক খেতে থাকে। এই নবজাতকের ভিতর সে দেখতে পায় জীবনের সব রূপ এবং সৌন্দর্য। যার ফলে দুনিয়ার প্রতি তার আগ্রহ এবং সম্পর্ক আরো গভীরতর হয়। পরম আদর-যত্নে সে শিশুর প্রতিপালনে ব্যাস্ত হয়ে পড়ে। নিজের শরীরের নির্যাস দিয়ে তার খাবারের ব্যাবস্থা করে। নিজে কষ্ট করে তাকে সুখ দেয়। নিজে ক্ষুর্ধাত থেকে তাকে খাওয়ায়। নিজে নির্ঘূম রাত কাটায় সন্তানের ঘুমের জন্য। মা পরম আদর আর সবটুকু ভালোবাসা দিয়ে সন্তানকে ঘিরে রাখে সর্বক্ষণ। সন্তান কোথাও গেলে আল্লাহর নিকট দুআ করে যেন তার সন্তান নিরাপদে ঘরে ফিরে আসে। সন্তানও যে কোন বিপদে ছুটে আসে মায়ের কোলে। পরম নির্ভরতায় ভরে থাকে তার বুক। যত বিপদই আসুক না কেন মা যদি বুকের সাথে চেপে ধরে কিংবা স্নেহ মাখা দৃষ্টিতে একবার তাকায় তাহলে সব কষ্ট যেন নিমিষেই উধাও হয়ে যায়। এই হল মা।
আর পিতা? তাকে তো সন্তানের মুখে এক লোকমা আহার তুলে দেয়ার জন্য করতে হয় অক্লান্ত পরিশ্রম। মাথার ঘাম পায়ে ফেলতে হয়। সহ্য করতে হয় কতধরণের কষ্ট এবং ক্লেশ। সন্তানের জন্যই তো তাকে কখনো কখনো কৃপনতা করতে হয়। কখনো বা ভীরুতার পরিচয় দিতে হয়। সন্তান কাছে গেলে হাঁসি মুখে তাকে বুকে টেনে নেয়। তার নিরাপত্তা ও শান্তির জন্য সে যে কোন ধরণের বিপদের সম্মুখীন হওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকে। ইত্যাদি কারণে আমাদের অস্তিতের প্রতিটি কোণা পিতা-মাতার নিকট ঋণী। আর তাই তো আল কুরআনে আল্লাহ তা’আলার ইবাদতের পরই পিতা-মাতার প্রতি সদাচারণ করার কথা উচ্চারিত হয়েছে বার বার। ইরশাদ হচ্ছেঃ “তোমার প্রতিপালক নির্দেশ দিয়েছেন যে, তোমরা তিনি ছাড়া অন্য কারো ইবাদত করবে না এবং পিতা-মাতার প্রতি সদ্ব্যবহার করবে; তাদের একজন অথবা উভয়ে উভয়েই তোমার জীবদ্দশায় বার্ধক্যে উপনীত হলেও আদেরকে বিরক্তি সূচক কিছু বলো না। এবং তাদেরকে ভর্র্ৎসনা করো না; তাদের সাথে কথা বলো সম্মান সূচক নম্র কথা।” [সূরা বনী ইসরাঈলঃ ২৩]
আল কুরআনের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ভাষ্যকার, প্রখ্যাত সাহাবী অবদুল্লাহ ইবন আব্বাস (রাঃ) বলেনঃ আল কুরআনে এমন তিনটি আয়াত আছে যেখানে তিনটি জিনিস তিনটি জিনিসের সাথে অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িত। একটি ছাড়া অন্যটি অগ্রহণযোগ্য। সে তিনটি আয়াত হলঃ
১) আল্লাহ তাআলা বলেন: “হে মুমিনগণ, তোমরা আল্লাহর আনুগত্য কর এবং আনুগত্য কর তার রাসূলের। এবং (তাদের বিরুদ্ধাচারণ করে) নিজেদের আমল বিনষ্ট কর না।” [সূরা মুহাম্মাদ: ৩৩]
কেউ যদি আল্লাহর আনুগত্য করে কিন্তু রাসূলের আনুগত্য না করে তাহলে তা আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না।
২) আল্লাহ তায়ালা বলেন: “এবং তোমরা সালাত (নামায) আদায় কর এবং যাকাত দাও।” [সূরা বাক্বারাঃ ৪৩]
কেউ যদি নামায পড়ে কিন্তু যাকাত দিতে রাজী নয় তাহলে তাও আল্লাহর দরবারে গ্রহণীয় নয়।
৩) আল্লাহ তায়ালা বলেন: “আমার কৃতজ্ঞতা এবং তোমার পিতা-মাতার কৃতজ্ঞতা আদায় কর।” [সূরা লোকমানঃ ১৪]
কেউ যদি আল্লাহর কৃতজ্ঞতা আদায় করে কিন্তু পিতা-মাতার কৃতজ্ঞতা আদায় না করে তবে তা আল্লাহর নিকট প্রত্যাখ্যাত। সে কারণেই মহাগ্রন্থ আল কুরআনে একাধিকবার আল্লাহর আনুগত্যের নির্দেশের সাথে সাথে পিতা-মাতার আনুগত্য করার প্রতি নির্দেশ এসেছে। ধ্বনীত হয়েছে তাদের সাথে খারাপ আচরণ করার প্রতি কঠিন হুশিয়ারী। তা যে কোন কারণেই হোক না কেন। ইরশাদ হচ্ছে:“তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর। এবং তার সাথে কাউকে শরীক কর না আর পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহার কর।” [সূরা নিসাঃ ৩৬]
আল্লাহ তাআলা আরো ইরশাদ করেন: “আমি মানুষকে নির্দেশ দিয়েছি তার পিতা-মাতার প্রতি সদ্ব্যবহার করতে।” [সূরা আনকাবূতঃ ৮]
তিনি আরও বলেন: “আর আমি তো মানুষকে তার পিতা-মাতার প্রতি সদাচারণের নির্দেশ দিয়েছি। তার জননী তাকে (সন্তানকে) কষ্টের পর কষ্ট বরণ করে গর্ভে ধারণ করে এবং তার দুধ ছাড়ানো হয় দুই বছরে। সুতরাং আমার প্রতি ও তোমার পিতা-মাতার প্রতি কৃতজ্ঞ হও। প্রত্যাবর্তন তো আমারই নিকট।” [সূরা লোকমানঃ ১৪]
উল্লেখিত আয়াতগুলোতে স্পষ্টভাবে পিতা-মাতার মর্যাদা এবং তাদের প্রতি সন্তানদের অধিকারের প্রমান বহন করছে।
প্রিয় নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হাদীস থেকেঃ নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর হাদীস থেকেও এ ব্যাপারে স্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়ঃ
১) পিতা-মাতার সন্তুষ্টিতে আল্লাহর সন্তুষ্টিঃ রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেনঃ “পিতা-মাতার সন্তুষ্টির উপরই আল্লাহর সন্তুষ্টি আর পিতা-মাতার অসন্তষ্টির উপরই আল্লাহর সন্তুষ্টি নির্ভর করছে।” [ত্ববারানী কাবীর-সহীহ]
২) ফিরে যাও, তাদের মুখে হাঁসি ফোটাওঃ আবদুল্লাহ ইবন আমর ইবন আস (রাঃ) থেকে বর্ণিত: “জনৈক সাহাবী নবী করীম (সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর নিকট এসে বললেন, আমি আপনার কাছে এসেছি হিজরত করার জন্য শপথ করতে। আমি যখন আসি আমার পিতা-মাতা কাঁদছিলেন। রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, “তাদের কাছে ফিরে যাও, এবং যেমন তাদেরকে কাঁদিয়েছিলে এখন তাদেরকে গিয়ে হাঁসাও।” [আবু দাউদ, নাসাঈ,ইবন মাজাহ-সহীহ]
৩) তার পা ধর, ওখানেই তোমার জান্নাতঃ “মুয়া’বিয়া ইবন জাহাম সুহামী নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর সাথে জিহাদে যাওয়ার অনুমতি চাইলে তিনি তাকে ফিরে যাওয়ার নির্দেশ দিয়ে বললেন, “যাও, তোমার আম্মার সেবা কর।” কিন্তু তিনি জিহাদে যাওয়ার জন্য বার বার অনুরোধ জানাতে থাকলে তিনি বললেন, “হায় আফসোস! তোমার মার পা ধরে থাক। ওখানেই তোমার জান্নাত।” [মুসনাদ আহমাদও ইবন মাজাহ্]
৪) পিতার তুলনায় মার অধিকার তিনগুণ বেশীঃ সর্বাধিক হাদীস বর্ণনাকারী সাহাবী আবূ হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত, “একলোক রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর নিকট এসে বলল, হে আল্লাহর রাসূল, আমার উত্তম সংশ্রব পাওয়ার জন্য কে সবচেয়ে বেশী উপযুক্ত? তিনি বললেন, তোমার মা।” লোকটি আবার প্রশ্ন করল, তারপর কে? তিনি বললেন, তোমার মা। সে আবার প্রশ্ন করল, তারপর কে? তিনি বললেন, “তোমার মা।” সে আবার প্রশ্ন করল, তারপর কে? তিনি বললেন, “তোমার পিতা।” [বুখারী-মুসলিম]
অত্র হাদীস প্রমাণ বহন করে, পিতার তুলনায় মা তিনগুণ সদাচারণ পাওয়ার অধিকারী। কারণ, গর্ভে ধারণ, ভুমিষ্ট ও দুগ্ধদানের ক্ষেত্রে কেবল মাকেই অবর্ণনীয় কষ্ট সহ্য করতে হয়। পিতা কেবল সন্তান প্রতিপালনে স্ত্রীর সাথে অংশ গ্রহণ করে। এদিকে ইঙ্গিত করে আল্লাহ ত।আলা ইরশাদ করেনঃ “আমি তো মানুষকে তার পিতা-মাতার প্রতি সদাচারণের নির্দেশ দিয়েছি। তার জননী তাকে (সন্তানকে) গর্ভে ধারণ করেছে কষ্টের সাথে এবং প্রসব করেছে কষ্টের সাথে। তাকে গর্ভে ধারতে ও তার স্তন ছাড়াতে সময় লাগে ত্রিশ মাস।” [আহক্বাফঃ ১৫]
৫) পিতা-মাতার অবাধ্য সন্তানের প্রতি আল্লাহ তা’আলা কিয়ামতের দিন তাকাবেন নাঃ রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ইরশাদ করেনঃ “তিন শ্রেণীর লোকের প্রতি আল্লাহ তা’আলা তাকাবেন না। তাদের মধ্যে একজন হল, পিতা-মাতার অবাধ্য সন্তান।” [সহীহ-নাসঈ, আহমাদ, হাকেম]
৬) পিতা-মাতার অবাধ্য সন্তান জান্নাতে প্রবেশ করবে নাঃ রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ইরশাদ করেনঃ “তিন শ্রেণীর লোক জান্নাতে প্রবেশ করবে না। তাদের মধ্যে একজন হল, পিতা-মাতার অবাধ্য সন্তান।” [সহীহ-নাসঈ, আহমাদ, হাকেম]
৭) তবুও অবাধ্যতা নয়ঃ মু’য়ায (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, “রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমাকে দশটি বিষয়ে উপদেশ দিয়ে গেছেন। তা হলো, আল্লাহর সাথে শিরক করবে না যদিও তোমাকে কেটে টুকরো টুকরো করে দেয়া হয় এবং আগুনে পুড়িয়ে ছারখার করে দেয়া হয়। এবং পিতা-মাতার অবাধ্য হবে না যদিও তারা তোমাকে তোমার পরিবার, এবং সম্পদ ছেড়ে চলে যেতে বলে…।” [মুসনাদ আহমাদ]
নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এবং তাঁর মাঃ পিতা-মাতার সাথে কিরূপ আচরণ করতে হবে সে ব্যাপারে ইতোপূর্বে প্রিয় নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর একাধিক হাদীস উল্লেখ করা হয়েছে। এখন দেখব নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তার মা-জননীর প্রতি বাস্তব জীবনে আমাদের জন্য কী আদর্শ রেখে গেছেন।
সহীহ্ মুসলিমে বর্ণিত হয়েছে, “হুদায়বিয়া সন্ধির সময় প্রিয় নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাহাবীদের সাথে নিয়ে যাচ্ছিলেন। সাথে আছে এক হাযার ঘোড় সাওয়ার। মক্কা ও মদীনার মাঝে আবওয়া নামক স্থানে তাঁর প্রাণ প্রিয় মা-জননী চির নিদ্রায় শায়িত আছেন। সে পথ দিয়ে যাওয়ার সময় তিনি যাত্রা বিরতী করে তাঁর মা’র কবর যিয়ারত করতে গেলেন। কবরের কাছে গিয়ে তিনি কাঁন্নায় ভেঙ্গে পড়লেন। তার চর্তুদিকে দাঁড়িয়ে থাকা সাহাবীগণও কাঁদতে লাগলেন। অতঃপর তিনি বললেন, আমি আল্লাহর দরবারে আমার মা’র জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করার অনুমতি চেয়েছিলাম কিন্তু অনুমতি দেয়া হয়নি। কিন্তু তার কবর যিয়ারতের জন্য অনুমতি প্রার্থনা করলে তিনি তাতে অনুমতি দেন। সুতরাং তোমরা কবর যিয়ারত কর। কারণ, কবর যিয়ারত করলে পরকালের কথা স্মরণ হয়।” [সহীহ মুসলিম]
ইবরাহীম (আঃ) এবং তার পিতা-মাতাঃ ইবরাহীম (আঃ) এর পিতা-মাতা কাফের ছিল। তারপরও তিনি তাদের সাথে অত্যন- বিনয় ও ভদ্রতা সুলোভ আচরণ করতেন। তিনি তার পিতাকে শিরক পরিত্যাগ করে এক আল্লাহর ইবাদত করার জন্য আহবান জানাচ্ছেনঃ আব্বাজান, আপনি কেন এমন জিনিসের ইবাদত করছেন যা শুনে না, দেখে না এবং আপনার কোন উপকারও করতে পারে না? কিন্তু সে তা শুধু প্রত্যাখ্যানই করল না বরং তাকে মেরে-পিটে তাড়িয়ে দেয়ার হুমকি দিল। তখন তিনি শুধু এতটুকুই বলেছিলেনঃ “আপনাকে সালাম। আমি আপনার জন্য আল্লাহর জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করব।” [সূরা মারইয়ামঃ ৪৭]
ইয়াহয়া (আঃ): আল্লাহ তা’আলা তার প্রশংসা করে বলেনঃ “সে তার পিতা-মাতার প্রতি সদাচারী ছিল।” [সূরা মারইয়ামঃ ১৪]
এভাবে অনেক নবীর কথা আল কুরআনে উল্লেখ করে আল্লাহ তা’আলা বিশ্ববাসীর সামনে অনুকরণীয় আদর্শ উপস্থাপন করেছেন। আমাদের পূর্ব পুরুষগণ পিতা-মাতার সাথে সর্বোচ্চ সদ্ব্যবহার করে বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন। এসমস্ত মহামনিষীদের মধ্যে আবু হুরাইরা (রাঃ), আবদুল্লাহ্ ইবন্ মাসঊদ (রাঃ), ইবন্ হাসান তামীমী (রহঃ), ইবন আউন মুযানী (রহঃ) প্রমুখের নাম ইতিহাসখ্যাত।
পিতা-মাতার অবাধ্যতার বিভিন্ন রূপঃ পিতা-মাতার অবাধ্যতার বিভিন্ন রূপ হতে পারে যা হয়ত অনেক মানুষের কাছেই অজানা।
  • পিতা-মাতার উপর নিজেকে বড় মনে করা। অর্থ-সম্পদ, শিক্ষা-দীক্ষা, সম্মান-প্রতিপত্তিতে পিতা-মাতার চেয়ে বেশী অথবা অন্য যে কোন কারণেই হোক না কেন নিজেকে বড় বড় মনে করা।
  • পিতা-মাতাকে পিতা-মাতাকে সহায়-সম্বলহীন এবং নিঃস্ব অবস্থায় ফেলে রাখা এবং যার কারণে তারা মানুষের দ্বারে দ্বারে হাত পাততে বাধ্য হয়।
  • বন্ধু-বান্ধব, স্ত্রী-পুত্র বা অন্য কাউকে, এমনকি নিজের প্রয়োজনকেও পিতা-মাতার উপর অগ্রাধিকার দেয়া তাদের নাফরমানীর অন্তর্ভূক্ত।
  • পিতা-মাতাকে শুধু নাম ধরে বা এমন শব্দ প্রয়োগে ডাকা যা তাদের অসম্মান ও মর্যাদাহানীর ইঙ্গিত দেয়।
  • পিতা-মাতার সাথে চোখ রাঙ্গিয়ে ধমকের সাথে কথা বলা।
  • তাদের সেবা-শশ্রুসা না করা এবং শারিরীক বা মানষিক দিকের প্রতি লক্ষ না রাখা। বিশেষ করে বৃদ্ধ বয়সে বা রোগ-ব্যধিতে তাদের প্রতি অবহেলা প্রদর্শন করা।
পরিশেষেঃ প্রতিটি জ্ঞানবান মানুষের আছে আহবান জানাবো, আসুন, পিতা-মাতার ব্যাপারে অবহেলা করার ব্যাপারে সাবধানত হই। তাদের প্রতি প্রর্দশন করি সর্বোচ্চ সম্মান জনক আচরণ। কারণ এর মাধ্যমেই আমাদের পার্থিব জীবন সুন্দর হবে। গুনাহ-খাতা মাফ হবে। পরকালে মিলবে চির সুখের নিবাস জান্নাত। মহিমাময় আল্লাহর দরবারে প্রার্থনা জানাই হে পরওয়ারদেগার, আমাদেরকে আমাদের পিতা-মাতার সাথে চির শান্তির নীড় জান্নাতে একত্রিত করিও। এটাই আমাদের জীবনের সবচেয়ে বড় প্রত্যাশা।

সুরা: ইয়াসিন আরবি & বাংলা উচ্চারণ

সুরা: ইয়াসিন بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَٰنِ الرَّحِيمِ আরবি & বাংলা উচ্চারণ বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম (পরম করুণাময় অতি দয়ালু আল...